Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Test link

দেবী চৌধুরাণী – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | Devi Chaudhurani by Bankim Chandra Chatterjee part 3

তৃতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ

বৈশাখী শুক্লা সপ্তমী আসিল, কিন্তু দেবী রাণীর ঋণ পরিশোধের কোন উদ্যোগ হইল না। হরবল্লভ এক্ষণে অঋণী, মনে করিলে অনায়াসে অর্থসংগ্রহ করিয়া দেবীর ঋণ পরিশোধ করিতে পারিতেন, কিন্তু সে দিকে মন দিলেন না। তাঁহাকে এ বিষয়ে নিতান্ত নিশ্চেষ্ট দেখিয়া ব্রজেশ্বর দুই চারিবার এ কথা উথ্থাপন করিলেন, কিন্তু হরবল্লভ তাঁহাকে স্তোকবাক্যে নিবৃত্ত করিলেন। এদিকে বৈশাখ মাসের শুক্লা সপ্তমী প্রায়াগতা–দুই চারি দিন আছে মাত্র। তখন ব্রজেশ্বর পিতাকে টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। হরবল্লভ বলিলেন, “ভাল, ব্যস্ত হইও না। আমি টাকার সন্ধানে চলিলাম। ষষ্ঠীর দিন ফিরিব।” হরবল্লভ শিবিকারোহণে পাচক ব্রাহ্মণ, ভৃত্য ও দুই জন লাঠিয়াল (পাইক) সঙ্গে লইয়া গৃহ হইতে যাত্রা করিলেন।

হরবল্লভ টাকার চেষ্টায় গেলেন বটে, কিন্তু সে আর এক রকম। তিনি বরাবর রঙ্গপুর গিয়া কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন। তখন কালেক্টরই শান্তিরক্ষক ছিলেন। হরবল্লভ তাঁহাকে বলিলেন, “আমার সঙ্গে সিপাহী দিউন, আমি দেবী চৌধুরাণীকে ধরাইয়া দিব। ধরাইয়া দিতে পারিলে আমাকে কি পুরস্কার দিবেন বলুন।”

শুনিয়া সাহেব আনন্দিত হইলেন। তিনি জানিতেন যে, দেবী চৌধুরাণী দস্যুদিগের নেত্রী। তাহাকে ধরিতে পারিলে আর আর সকলে ধরা পড়িবে। তিনি দেবীকে ধরিবার অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন, কোন মতে সফল হইতে পারেন নাই। অতএব হরবল্লভ সেই ভয়ঙ্করী রাক্ষসীকে ধরাইয়া দিবে শুনিয়া সাহেব সন্তুষ্ট হইলেন। পুরস্কার দিতে স্বীকৃত হইলেন। হরবল্লভ বলিলেন, “আমার সঙ্গে পাঁচ শত সিপাহী পাঠাইতে হুকুম হউক।” সাহেব সিপাহীর হুকুম দিলেন। হরবল্লভকে সঙ্গে করিয়া লেফটেনাণ্ট ব্রেনান সিপাহী লইয়া দেবীকে ধরিতে চলিলেন।

হরবল্লভ ব্রজেশ্বরের নিকট সবিশেষ শুনিয়াছিলেন, ঠিক সে ঘাটে দেবীকে পাওয়া যাইবে। সম্ভবতঃ দেবী বজরাতেই থাকিবে। লেফটেেনাণ্ট ব্রেনান সেই জন্য কতক ফৌজ লইয়া ছিপে চলিলেন। এইরূপ পাঁচখানি ছিপ ভাঁটি দিয়া দেবীর বজরা ঘেরাও করিতে চলিল। এদিকে লেফটেনাণ্ট সাহেব আর কতক সিপাহী সৈন্য লুক্কায়িত ভাবে, বন দিয়া বন দিয়া তটপন্থে পাঠাইলেন। যেখানে দেবীর বজরা থাকিবে, হরবল্লভ বলিয়া দিল; সেইখানে তীরবর্তী বনমধ্যে ফৌজ তিনি লুকাইয়া রাখিলেন, যদি দেবী ছিপের দ্বারা আক্রান্ত হইয়া তটপথে পলাইবার চেষ্টা করে, তবে তাহাকে এই ফৌজের দ্বারা ঘেরাও করিয়া ধরিবেন। আরও এক পলাইবার পথ ছিল–ছিপগুলি ভাঁটি দিয়া আসিবে, দূর হইতে ছিপ দেখিতে পাইলে দেবী ভাঁটি দিয়া পলাইতে পারে, অতএব লেফটেনাণ্ট ব্রেনান অবশিষ্ট সিপাহীগুলিকে দুই ক্রোশ ভাঁটিতে পাঠাইলেন, তাহাদিগের থাকিবার জন্য এমন একটি স্থান নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন যে, সেখানে ত্রিস্রোতা নদী এই শুকার সময়ে সহজে হাঁটিয়া পার হওয়া যায়। সিপাহীরা সেখানে তীরে লুকাইয়া থাকিবে, বজরা দেখিলেই জলে আসিয়া তাহা ঘেরাও করিবে।
সন্ন্যাসিনী রমণীকে ধরিবার জন্য এইরূপ ঘোরতর আড়ম্বর হইল। কিন্তু কর্তৃপক্ষেরা এ আড়ম্বর নিষ্প্রয়োজন মনে করেন নাই। দেবী সন্ন্যাসিনী হউক আর নাই হউক, তাহার আজ্ঞাধীন হাজার যোদ্ধা আছে, সাহেবেরা জানিতেন। এই যোদ্ধাদিগের নাম “বরকন্দাজ”। অনেক সময়ে কোম্পানীর সিপাহীদিগকে এই বরকন্দাজদিগের লাঠির চোটে পলাইতে হইয়াছিল, এইরূপ প্রবাদ। হায় লাঠি! তোমার দিন গিয়াছে! তুমি ছার বাঁশের বংশ বটে, কিন্তু শিক্ষিত হস্তে পড়িলে তুমি না পারিতে, এমন কাজ নাই। তুমি কত তরবারি দুই টুকরা্ করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ, কত ঢাল-খাঁড়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিয়াছ–হায়! বন্দুক আর সঙ্গীন তোমার প্রহারে যোদ্ধার হাত হইতে খসিয়া পড়িয়াছে। যোদ্ধা ভাঙ্গা হাত লইয়া পলাইয়াছে। লাঠি! তুমি বাঙ্গালায় আব্রু পর্দা রাখিতে, মান রাখিতে, ধন রাখিতে, জন রাখিতে, সবার মন রাখিতে। মুসলমান তোমার ভয়ে ত্রস্ত ছিল, ডাকাইত তোমার জ্বালায় ব্যস্ত ছিল, নীলকর তোমার ভয়ে নিরস্ত ছিল। তুমি তখনকার পীনাল কোড ছিলে–তুমি পীনাল কোডের মত দুষ্টের দমন করিতে, পীনাল কোডের মত শিষ্টেরও দমন করিতে এবং পীনাল কোডের মত রামের অপরাধে শ্যামের মাথা ভাঙ্গিতে। তবে পীনাল কোডের উপর তোমার এই সরদারি ছিল যে, তোমার উপর আপীল চলিত না। হায়! এখন তোমার সে মহিমা গিয়াছে! পীনাল কোড তোমাকে তাড়াইয়া তোমার আসন গ্রহণ করিয়াছে–সমাজ-শাসন-ভার তোমার হাত হইতে তার হাতে গিয়াছে। তুমি, লাঠি! আর লাঠি নও, বংশখণ্ড মাত্র! ছড়িত্ব প্রাপ্ত হইয়া শৃগাল-কুক্কুর-ভীত বাবুবর্গের হাতে শোভা কর; কুক্কুর ডাকিলেই সে ননীর হাতগুলি হইতে খসিয়া পড়। তোমার সে মহিমা আর নাই। শুনিতে পাই, সেকালে তুমি না কি উত্তম ঔষধ ছিলে–মানসিক ব্যাধির উত্তম চিকিৎসকদিগের মুখে শুনিতে পাই, “মূর্খস্য লাঠ্যৌষধং।” এখন মূর্খের ঔষধ “বাপু” “বাছা”–তাহাতেও রোগ ভাল হয় না। তোমার সগোত্র সপিণ্ডগণের মধ্যে অনেকেরই গুণ এই দুনিয়াতে জাজ্বল্যমান। ইস্তক আড়া বাঁকারি খুঁটি খোঁটা লাগায়েৎ শ্রীনন্দনন্দনের মোহন বংশী, সকলেরই গুণ বুঝি–কিন্তু লাঠি! তোমার মত কেহ না। তুমি আর নাই–গিয়াছ। ভরসা করি, তোমার অক্ষয় স্বর্গ হইয়াছে; তুমি ইন্দ্রলোকে গিয়া নন্দনকাননের পুষ্পভারাবনত পারিজাত-বৃক্ষ-শাখার ঠেকনো হইয়া আছ, দেবকন্যারা তোমার ঘায় কল্পবৃক্ষ হইতে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষরূপ ফল সকল পাড়িয়া লইতেছে। এক আধটা ফল যেন পৃথিবীতে গড়াইয়া পড়ে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

যার লাঠির ভয়ে এত সিপাহীর সমাগম, তার কাছে একখানি লাঠিও ছিল না। নিকটে একটা লাঠিয়ালও ছিল না। দেবী সেই ঘাটে–যে ঘাটে বজরা বাঁধিয়া ব্রজেশ্বরকে বন্দী করিয়া আনিয়াছিল, সেই ঘাটে। সবে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে মাত্র। সেই বজরা তেমনই সাজান–সব ঠিক সে রকম নয়। সে ছিপখানি সেখানে নাই–তাহাতে যে পঞ্চাশ জন লাঠিয়াল ছিল, তাহারা নাই। তার পর বজরার উপরেও একটি পুরুষমানুষ নাই–মাঝি-মল্লা, রঙ্গরাজ প্রভৃতি কেহ নাই। কিন্তু বজরার মাস্তুল উঠান–চারিখানা পাল তোলা আছে–বাতাসের অভাবে পাল মাস্তুলে জড়ান পড়িয়া আছে। বজরার নোঙ্গরও ফেলা নহে, কেবল দুগাছা কাছিতে তীরে খোঁটায় বাঁধা আছে।

তৃতীয়, দেবী নিজে তেমন রত্নাভরণভূষিতা মহার্ঘবস্ত্রপরিহিতা নয়, কিন্তু আর এক প্রকারে শোভা আছে। ললাট, গণ্ড, বাহু, হৃদয়, সর্বাঙ্গ সুগন্ধি চন্দনে চর্চিত; চন্দনচর্চিত ললাট বেষ্টন করিয়া সুগন্ধি পুষ্পের মালা শিরোদেশের বিশেষ শোভা বৃদ্ধি করিয়াছে। হাতে ফুলের বালা। অন্য অলঙ্কার একখানিও নাই। পরণে সেই মোটা সাড়ি।

আর, আজ দেবী একা ছাদের উপর বসিয়া নহে, কাছে আর দুই জন স্ত্রীলোক বসিয়া। একজন নিশি, অপর দিবা। এই তিন জনে যে কথাটা হইতেছিল, তাহার মাঝখান হইতে বলিলেও ক্ষতি নাই।

দিবা বলিতেছিল–দিবা অশিক্ষিতা, ইহা পাঠকের স্মরণ রাখা উচিত–বলিতেছিল, “হাঁঃ, পরমেশ্বরকে না কি আবার প্রত্যক্ষ দেখা যায়?”

প্রফুল্ল বলিল, “না, প্রত্যক্ষ দেখা যায় না। কিন্তু আমি প্রত্যক্ষ দেখার কথা বলিতেছিলাম না–আমি প্রত্যক্ষ করার কথা বলিতেছিলাম। প্রত্যক্ষ ছয় রকম। তুমি যে প্রত্যক্ষ দেখার কথা কহিতেছিলে, সে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ–চক্ষের প্রত্যক্ষ। আমার গলার আওয়াজ তুমি শুনিতে পাইতেছ–আমার গলার আওয়াজ তোমার শ্রবণ প্রত্যক্ষ, অর্থাৎ কাণের প্রত্যক্ষের বিষয় হইতেছে। আমার হাতের ফুলের গন্ধ তোমার নাকে যাইতেছে কি?”

দি। যাইতেছে।

দেবী। ওটা তোমার ঘ্রাণজ প্রত্যক্ষ হইতেছে। আর আমি যদি তোমার গালে এক চড় মারি, তাহা হইলে তুমি আমার হাতকে প্রত্যক্ষ করিবে–সেটা ত্বাচ প্রত্যক্ষ। আর এখনি নিশি যদি তোমার মাথা খায়, তাহা হইলে তোমার মগজটা তার রাসন প্রত্যক্ষ হইবে।

দি। মন্দ প্রত্যক্ষ হইবে না। কিন্তু পরমেশ্বরকে দেখাও যায় না, শোনাও যায় না, শোঁকাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না, খাওয়াও যায় না। তাঁকে প্রত্যক্ষ করিব কি প্রকারে?

নি। এ ত গেল পাঁচ রকম প্রত্যক্ষ। ছয় রকম প্রত্যক্ষের কথা বলিয়াছি; কেন না, চক্ষু কর্ণ, নাসিকা, রসনা ও ত্বক ছাড়া আর একটা জ্ঞানেন্দ্রিয় আছে, জান না?

দি। কি, দাঁত?

নি। দূর হ, পোড়ারমুখী! ইচ্ছা করে, কিল মেরে তোর সে ইন্দ্রিয়ের পাটিকে পাটি ভেঙ্গে দিই।

দেবী। (হাসিতে হাসিতে) চক্ষুরাদি পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; হস্তপদাদি পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, আর ইন্দ্রিয়াধিপতি মন উভয়েন্দ্রিয় অর্থাৎ মন জ্ঞানেন্দ্রিয় বটে, কর্মেন্দ্রিয়ও বটে। মনঃ জ্ঞানেন্দ্রিয় বলিয়া মনের দ্বারাও প্রত্যক্ষ আছে। ইহাকে মানস প্রত্যক্ষ বলে। ঈশ্বর মানস প্রত্যক্ষের বিষয়।

নি। “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ–প্রমাণাভাবাৎ।”

যিনি সাংখ্যপ্রবচনসূত্র ও ভাষ্য পড়িয়াছেন, তিনি নিশির এই ব্যঙ্গোক্তির মর্ম বুঝিবেন। নিশি প্রফুল্লের এক প্রকার সহাধ্যায়িনী ছিল।

প্রফুল্ল উত্তর করিল, “সুত্রকারস্যোভয়েন্দ্রিয়শূন্যত্বাৎ–ন তু প্রমাণাভবাৎ”।

দি। রেখে দাও তোমার হাবাৎ মাবাৎ–আমি ত পরমেশ্বরকে কখন মনের ভিতর দেখিতে পাই নাই।

প্র। আবার দেখা? চাক্ষুষ প্রত্যক্ষই দেখা–অন্য কোন প্রত্যক্ষ দেখা নয়,–মানস প্রত্যক্ষও দেখা নয়। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের বিষয়–রূপ, বহির্বিষয়; মানস প্রত্যক্ষের বিষয়–অন্তর্বিষয়। মনের দ্বারা ঈশ্বর প্রত্যক্ষ হইতে পারেন। ঈশ্বরকে দেখা যায় না।
দি। কই? আমি ত ঈশ্বরকে কখনও মনের ভিতর কোন রকম প্রত্যক্ষ করি নাই?

প্র। মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যক্ষশক্তি অল্প–সাহায্য বা অবলম্বন ব্যতীত সকল বস্তু প্রত্যক্ষ করিতে পারে না।

দি। প্রত্যক্ষের জন্য আবার সাহায্য কি রকম? দেখ, এই নদী, জল, গাছ, পালা, নক্ষত্র, সকলই আমি বিনা সাহায্যে দেখিতে পাইতেছি।

‍ “সকলই নয়। ইহার একটি উদাহরণ দিব?” বলিয়া প্রফুল্ল হাসিল।

হাসির রকমটা দেখিয়া নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “কি?”

প্রফুল্ল বলিতে লাগিল, “ইংরেজের সিপাহী আমাকে আজ ধরিতে আসিতেছে জান?”

দিবা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “তা ত জানি।”

প্র। সিপাহী প্রত্যক্ষ করিয়াছ?

দি। না। কিন্তু আসিলে প্রত্যক্ষ করিব।

প্র। আমি বলিতেছি, আসিয়াছে, কিন্তু বিনা সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছি না। এই সাহায্য গ্রহণ কর। এই বলিয়া প্রফুল্ল দিবার হাতে দূরবীক্ষণ দিল। ঠিক যে দিকে দেখিতে হইবে, দেখাইয়া দিল। দিবা দেখিল। দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “কি দেখিলে?”

দি। একখানা ছিপ। উহাতে অনেক মানুষ দেখিতেছি বটে।

দেবী। উহাতে সিপাহী আছে। আর একখানা দেখ।

এরূপে দেবী দিবাকে পাঁচখানা ছিপ নানা স্থানে দেখাইল। নিশিও দেখিল। নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “ছিপগুলি চরে লাগাইয়া আছে দেখিতেছি। আমাদের ধরিতে আসিয়াছে, কিন্তু আমাদের কাছে না আসিয়া ছিপ তীরে লাগাইয়া আছে কেন?”

দেবী। বোধ হয়, ডাঙ্গা-পথে যে সকল সিপাহী আসিবে, তাহারা আসিয়া পৌঁছে নাই। ছিপের সিপাহী তাহাদের অপেক্ষায় আছে। ডাঙ্গার সিপাহী আসিবার আগে, ছিপের সিপাহী আগু হইলে, আমি ডাঙ্গা-পথে পলাইতে পারি, এই শঙ্কায় উহারা আগু হইতেছে না।

দি। কিন্তু আমরা ত উহাদের দেখিতে পাইতেছি; মনে করিলেই ত পলাইতে পারি।

দেবী। ওরা ত জানে না। ওরা জানে না যে, আমরা দূরবীন রাখি।

নি। ভগিনি! প্রাণে বাঁচিলে এক দিন না এক দিন স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবেক। আজ ডাঙ্গায় উঠিয়া প্রাণরক্ষা করিবে চল। এখনও যদি ডাঙ্গায় সিপাহী আসে নাই, তবে ডাঙ্গা- পথে এখন প্রাণরক্ষার উপায় আছে।

দেবী। যদি প্রাণের জন্য আমি এত কাতর হইব, তবে আমি সকল সংবাদ জানিয়া শুনিয়া এখানে আসিলাম কেন? আসিলাম যদি, তবে লোকজন সবাইকে বিদায় দিলাম কেন? আমার হাজার বরকন্দাজ আছে–তাহাদের সকলকে অন্য স্থানে পাঠাইলাম কেন?

দি। আমরা আগে যদি জানিতাম, তাহা হইলে তোমায় এমন কর্ম করিতে দিতাম না।

দেবী। তোমার সাধ্য কি, দিবা! আমি স্থির করিয়াছি, তা অবশ্য করিব। আজ স্বামিদর্শন করিব, স্বামীর অনুমতি লইয়া জন্মান্তরে তাঁহাকে কামনা করিয়া প্রাণ সমর্পণ করিব। তোমরা আমার কথা শুনিও, দিবা নিশি! আমার স্বামী যখন ফিরিয়া যাইবেন, তখন তাঁহার নৌকায় উঠিয়া তাঁহার সঙ্গে চলিয়া যাইও। আমি একা ধরা দিব, আমি একা ফাঁসি যাব। সেই জন্যই বজরা হইতে আর সকলকে বিদায় দিয়াছি। তোমরা তখন গেলে না। কিন্তু আমায় এই ভিক্ষা দাও–আমার স্বামীর নৌকায় উঠিয়া পলায়ন করিও।

নি। ধড়ে প্রাণ থাকিতে তোমায় ছাড়িব না। মরিতে হয়, একত্র মরিব।

প্র। ও সকল কথা এখন থাক–যাহা বলিতেছিলাম, তা বলিয়া শেষ করিব। যাহা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছিলে না, তা যেমন দূরবীক্ষণের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিলে, তেমন ঈশ্বরকে মানস প্রত্যক্ষ করিতে দূরবীন চাই।
দি। মনের আবার দূরবীন কি?

প্র। যোগ।

দি। কি–সেই ন্যাস, প্রাণায়াম, কুম্ভক, বুজরুকি, ভেল্কি–

প্র। তাকে আমি যোগ বলি না। যোগ অভ্যাস মাত্র। কিন্তু সকল অভ্যাসই যোগ নয়। তুমি যদি দুধ ঘি খাইতে অভ্যাস কর, তাকে যোগ বলিব না। তিনটি অভ্যাসকেই যোগ বলি।

দি। কি কি তিনটি?

প্র। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি। জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ।

তক্ষণ নিশি দূরবীন লইয়া এদিক ওদিক দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে বলিল, “সম্প্রতি উপস্থিত গোলযোগ।”

প্র। সে আবার কি? আবার গোলযোগ কি?

নি। একখানা পান্‌সি আসিতেছে। বুঝি ইংরেজের চর।

প্রফুল্ল নিশির হাত হইতে দূরবীন লইয়া পান্‌সি দেখিল। বলিল, “এই আমার সুযোগ। তিনিই আসিতেছেন। তোমরা নীচে যাও।”

দিবা ও নিশি ছাদ হইতে নামিয়া কামরার ভিতর গেল। পান্‌সি ক্রমে বাহিয়া আসিয়া বজরার গায়ে লাগিল। সেই পান্‌সিতে–ব্রজেশ্বর। ব্রজেশ্বর, লাফাইয়া বজরায় উঠিয়া, পান্‌সি তফাতে বাঁধিয়া রাখিতে হুকুম দিলেন। পান্‌সিওয়ালা তাহাই করিল।

ব্রজেশ্বর নিকটে আসিল, প্রফুল্ল উঠিয়া দাঁড়াইয়া আনত মস্তকে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিল। পরে উভয়ে বসিলে, ব্রজেশ্বর বলিল, “আজ টাকা আনিতে পারি নাই, দুই চারি দিনে দিতে পারিব বোধ হয়। দুই চারি দিনের পরে কবে কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা হইবে, সেটা জানা চাই।”

ও ছি! ছি! ব্রজেশ্বর! দশ বছরের পর প্রফুল্লের সঙ্গে এই কি কথা!

দেবী উত্তর করিল, “আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হইবে না–” বলিতে বলিতে দেবীর গলাটা বুজিয়া আসিল–দেবী একবার চোখ মুছিল –“আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু আমার ঋণ শুধিবার অন্য উপায় আছে। যখন সুবিধা হইবে, ঐ টাকা গরীব-দুঃখীকে বিলাইয়া দিবেন–তাহা হইলে আমি পাইব।”

ব্রজেশ্বর দেবীর হাত ধরিল। বলিল, “প্রফুল্ল! তোমার টাকা–”

ছাই টাকা! কথা শেষ হইল না–মুখের কথা মুখে রহিল। যেমন ব্রজেশ্বর “প্রফুল্ল” বলিয়া ডাকিয়া হাত ধরিয়াছে, অমনি প্রফুল্লের দশ বছরের বাঁধা বাঁধ ভাঙ্গিয়া, চোখের জলের স্রোত ছুটিল। ব্রজেশ্বরের ছাই টাকার কথা সে স্রোতে কোথায় ভাসিয়া গেল। তেজস্বিনী দেবী রাণী ছেলেমানুষের মত বড় কান্নাটা কাঁদিল। ব্রজেশ্বর ততক্ষণ বড় বিপন্ন হইলেন। তাঁর মনে মনে বোধ আছে যে, এ পাপীয়সী ডাকাইতি করিয়া খায়, এর জন্য এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলা হবে না। কিন্তু চোখের জল, অত বিধি ব্যবস্থা অবগত নয়, তারা অনাহূত আসায় ব্রজেশ্বরের চোখ ভরিয়া গেল। ব্রজেশ্বর মনে করিলেন, হাত উঠাইয়া চোখ মুছিলেই ধরা পড়িব। কাজেই চোখ মোছা হইল না। চোখ যখন মোছা হইল না, তখন পুকুর ছাপাইল–গাল বাহিয়া ধারা চলিল–প্রফুল্লের হাতে পড়িল।

তখন বালির বাঁধটা ভাঙ্গিয়া গেল। ব্রজেশ্বর মনে করিয়া আসিয়াছিলেন যে, প্রফুল্লকে ডাকাইতি করার জন্য ভারী রকম তিরস্কার করিবেন, পাপীয়সী বলিবেন–আরও দুই চারিটা লম্বা চৌড়া কথা বলিয়া আবার একবার জন্মের মত ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন। কিন্তু কেঁদে যার হাত ভিজিয়ে দিলেন, তার উপর কি আর লম্বা চৌড়া কথা হয়?
তখন চক্ষু মুছিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “দেখ প্রফুল্ল, তোমার টাকা আমার টাকা–তার পরিশোধের জন্য আমি কেন কাতর হব? কিন্তু আমি বড় কাতরই হইয়াছি। আমি আজ দশ বৎসর কেবল তোমাকেই ভাবিয়াছি। আমার আর দুই স্ত্রী আছে–আমি তাহাদিগকে এ দশ বৎসর স্ত্রী মনে করি নাই; তোমাকেই স্ত্রী জানি। কেন, তা বুঝি তোমায় আমি বুঝাইতে পারিব না। শুনিয়াছিলাম, তুমি নাই। কিন্তু আমার পক্ষে তুমি ছিলে। আমি তার পরও মনে জানিতাম, তুমিই আমার স্ত্রী–মনে আর কাহারও স্থান ছিল না। বলবে না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু বলাতেও ক্ষতি নাই–তুমি মরিয়াছ শুনিয়া, আমিও মরিতে বসিয়াছিলাম। এখন মনে হয়, মরিলেই ভাল হইত–না মরিয়াছিলে ত আমি মরিলেই ভাল হইত। এখন যাহা শুনিয়াছি, বুঝিয়াছি, তা শুনিতে হইত না, বুঝিতে হইত না। আজ দশ বৎসরের হারান ধন তোমায় পাইয়াছি, আমার স্বর্গসুখের অপেক্ষা অধিক সুখ হইত। তা না হয়ে প্রফুল্ল, আজ তোমায় পাইয়া মর্মান্তিক যন্ত্রণা।” তার পর একবার থামিয়া একটু ঢোক গিলিয়া, মাথা টিপিয়া ধরিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “মনের মন্দিরের ভিতর সোণার প্রতিমা গড়িয়া রাখিয়াছিলাম–আমার সেই প্রফুল্ল–মুখে আসে না–সেই প্রফুল্লের এই বৃত্তি!”

প্রফুল্ল বলিল, “কি? ডাকাইতি করি?”

ব্র। কর না কি?

ইহার উত্তরে প্রফুল্ল একটা কথা বলিতে পারিত। যখন ব্রজেশ্বরের পিতা প্রফুল্লকে জন্মের মত ত্যাগ করিয়া গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দেয়, তখন প্রফুল্ল কাতর হইয়া শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “আমি অন্নের কাঙ্গাল, তোমরা তাড়াইয়া দিলে–আমি কি করিয়া খাইব?” তাহাতে শ্বশুর উত্তর দিয়াছিলেন, “চুরি-ডাকাইতি করিয়া খাইও।” প্রফুল্ল মেধাবিনী–সে কথা ভুলে নাই। ভুলিবার কথাও নহে। আজ ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে ডাকাইত বলিয়া এই ভর্ৎসনা করিল; আজ প্রফুল্লের সেই উত্তর ছিল। প্রফুল্লের এই উত্তর ছিল, “আমি ডাকাইত বটে–তা এখন এত ভর্ৎসনা কেন? তোমরাই ত চুরি-ডাকাইতি করিয়া খাইতে বলিয়াছিলে। আমি গুরুজনের আজ্ঞা পালন করিতেছি।” এ উত্তর সম্বরণ করাই যথার্থ পুণ্য। প্রফুল্ল সে পুণ্য সঞ্চয় করিল, – সে কথা মুখেও আনিল না। প্রফুল্ল স্বামীর কাছে হাত জোড় করিয়া এই উত্তর দিল। বলিল, “আমি ডাকাইত নই। আমি তোমার কাছে শপথ করিতেছি, আমি কখন ডাকাইতি করি নাই। কখন ডাকাইতির এক কড়া লই নাই। তুমি আমার দেবতা। আমি অন্য দেবতার অর্চনা করিতে শিখিতেছিলাম–শিখিতে পারি নাই; তুমি সব দেবতার স্থান অধিকার করিয়াছ–তুমিই একমাত্র আমার দেবতা। আমি তোমার কাছে শপথ করিতেছি–আমি ডাকাইত নই। তবে জানি, লোকে আমাকে ডাকাইত বলে। কেন বলে, তাও জানি। সেই কথা তোমাকে আমার কাছে শুনিতে হইবে। সেই কথা শুনাইব বলিয়াই আজ এখানে আসিয়াছি। আজ না শুনিলে, আর শুনা হইবে না। শোন, আমি বলি।”

তখন যে দিন প্রফুল্ল শ্বশুরালয় হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিল, সেই দিন হইতে আজ পর্যন্ত আপনার কাহিনী সকলই অকপটে বলিল। শুনিয়া ব্রজেশ্বর বিস্মিত, লজ্জিত, অতিশয় আহ্লাদিত, আর মহামহিমময়ী স্ত্রীর সমীপে কিছু ভীত হইলেন। প্রফুল্ল সমাপন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমার এ কথাগুলিতে বিশ্বাস করিলে কি?”

অবিশ্বাসের জায়গা ছিল না–প্রফুল্লের প্রতি কথা ব্রজেশ্বরের হাড়ে হাড়ে বসিয়াছিল। ব্রজেশ্বর উত্তর করিতে পারিল না–কিন্তু তাহার আনন্দপূর্ণ কান্তি দেখিয়া প্রফুল্ল বুঝিল, বিশ্বাস হইয়াছে। তখন প্রফুল্ল বলিতে লাগিল, “এখন পায়ের ধূলা দিয়া এ জন্মের মত আমায় বিদায় দাও। আর এখানে বিলম্ব করিও না–সম্মুখে কোন বিঘ্ন আছে। তোমায় এই দশ বৎসরের পর পাইয়া এখনই উপযাচিকা হইয়া বিদায় দিতেছি, ইহাতেই বুঝিবে যে, বিঘ্ন বড় সামান্য নহে। আমার দুইটি সখী এই নৌকায় আছে। তাহারা বড় গুণবতী, আমিও তাহাদের বড় ভালবাসি। তোমার নৌকায় তাহাদের লইয়া যাও। বাড়ী পৌঁছিয়া, তারা যেখানে যাইতে চায়, সেইখানে পাঠাইয়া দিও। আমায় যেমন মনে রাখিয়াছিলে, তেমনি মনে রাখিও। সাগর যেন আমায় না ভুলে।”

ব্রজেশ্বর ক্ষণেক কাল নীরবে ভাবিল। পরে বলিল, “আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, প্রফুল্ল! আমায় বুঝাইয়া দাও। তোমার এত লোক–কেহ নাই! বজরার মাঝিরা পর্যন্ত নাই! কেবল দুইটি স্ত্রীলোক আছে, তাদেরও বিদায় করিতে চাহিতেছ। সম্মুখে বিঘ্ন বলিতেছ–আমাকে থাকিতে নিষেধ করিতেছ। আর এ জন্মে সাক্ষাৎ হইবে না বলিতেছ। এ সব কি? সম্মুখে কি বিঘ্ন আমাকে না বলিলে, আমি যাইব না। বিঘ্ন কি, শুনিলেও যাইব কি না, তাও বলিতে পারি না।”

প্র। সে সব কথা তোমার শুনিবার নয়।

ব্র। তবে আমি কি তোমার কেহ নই?

এমন সময় দুম্ করিয়া একটা বন্দুকের শব্দ হইল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
দুম্ করিয়া একটা বন্দুকের শব্দ হইল–ব্রজেশ্বরের মুখের কথা মুখে রহিল, দুই জনে চমকিয়া সম্মুখে চাহিয়া দেখিল–দেখিল, দূরে পাঁচখানা ছিপ আসিতেছে, বটিয়ার তাড়নে জল চাঁদের আলোয় জ্বলিতেছে। দেখিতে দেখিতে দেখা গেল, পাঁচখানা ছিপ সিপাহী-ভরা। ডাঙ্গা-পথের সিপাহীরা আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তারই সঙ্কেত বন্দুকের শব্দ। শুনিয়াই পাঁচখানা ছিপ খুলিয়াছিল। দেখিয়া প্রফুল্ল বলিল, “আর তিলার্ধ বিলম্ব করিও না। শীঘ্র আপনার পান্‌সিতে উঠিয়া চলিয়া যাও।”

ব্র। কেন? এ ছিপগুলো কিসের? বন্দুক কিসের?

প্র। না শুনিলে যাইবে না?

ব্র। কোন মতেই না।

প্র। এ ছিপে কোম্পানির সিপাহী আছে। এ বন্দুক ডাঙ্গা হইতে কোম্পানির সিপাহী আওয়াজ করিল।

ব্র। কেন এত সিপাহী এদিকে আসিতেছে? তোমাকে ধরিবার জন্য?

প্রফুল্ল চুপ করিয়া রহিল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কথায় বোধ হইতেছে, তুমি পূর্ব হইতে এই সংবাদ জানিতে।”

প্র। জানিতাম–আমার চর সর্বত্র আছে।

ব্র। এ ঘাটে আসিয়া জানিয়াছ, না আগে জানিয়াছ?

প্র। আগে জানিয়াছিলাম।

ব্র। তবে, জানিয়া শুনিয়া এখানে আসিলে কেন?

প্র। তোমাকে আর একবার দেখিব বলিয়া।

ব্র। তোমার লোকজন কোথায়?

প্র। বিদায় দিয়াছি। তারা কেন আমার জন্য মরিবে?

ব্র। নিশ্চিত ধরা দিবে, স্থির করিয়াছ?

প্র। আর বাঁচিয়া কি হইবে? তোমার দেখা পাইলাম, তোমাকে মনের কথা বলিলাম, তুমি আমায় ভালবাস, তাহা শুনিলাম। আমার যে কিছু ধন ছিল, তাহাও বিলাইয়া শেষ করিয়াছি। আর এখন বাঁচিয়া কোন্ কাজ করিব বা কোন্ সাধ মিটাইব? আর বাঁচিব কেন?

ব্র। বাঁচিয়া, আমার ঘরে গিয়া, আমার ঘর করিবে।

প্র। সত্য বলিতেছ?

ব্র। তুমি আমার কাছে শপথ করিয়াছ, আমিও তোমার কাছে শপথ করিতেছি। আজ যদি তুমি প্রাণ রাখ, আমি তোমাকে আমার ঘরণী গৃহিণী করিব।

প্র। আমার শ্বশুর কি বলিবেন?

ব্র। আমার বাপের সঙ্গে আমি বোঝাপড়া করিব।

প্র। হায়! এ কথা কাল শুনি নাই কেন?

ব্র। কাল শুনিলে কি হইত?

প্র। তাহা হইলে কার সাধ্য আজ আমায় ধরে?

ব্র। এখন?

প্র। এখন আর উপায় নাই। তোমার পান্‌সি ডাক–নিশি ও দিবাকে লইয়া শীঘ্র যাও।
ব্রজেশ্বর আপনার পান্‌সি ডাকিল। পান্‌সিওয়ালা নিকটে আসিলে, ব্রজেশ্বর বলিল, “তোরা শীঘ্র পলা, ঐ কোম্পানির সিপাহীর ছিপ আসিতেছে; তোদের দেখিলে উহারা বেগার ধরিবে। শীঘ্র পলা, আমি যাইব না, এইখানে থাকিব।”

পান্‌সির মাঝি মহাশয়, আর দ্বিরুক্তি না করিয়া, তৎক্ষণাৎ পান্‌সি খুলিয়া প্রস্থান করিলেন। ব্রজেশ্বর চেনা লোক, টাকার ভাবনা নাই।

পান্‌সি চলিয়া গেল দেখিয়া প্রফুল্ল বলিল, “তুমি গেলে না?”

ব্র। কেন, তুমি মরিতে জান, আমি জানি না? তুমি আমার স্ত্রী–আমি তোমায় শত বার ত্যাগ করিতে পারি। কিন্তু আমি তোমার স্বামী–বিপদে আমিই ধর্মতঃ তোমার রক্ষাকর্তা। আমি রক্ষা করিতে পারি না–তাই বলিয়া কি বিপদ্কা লে তোমাকে ত্যাগ করিয়া যাইব?

“তবে কাজেই আমি স্বীকার করিলাম, প্রাণরক্ষার যদি কোন উপায় হয়, তা আমি করিব।” এই বলিতে বলিতে প্রফুল্ল আকাশপ্রান্তে দৃষ্টিপাত করিল। যাহা দেখিল, তাহাতে যেন কিছু ভরসা হইল। আবার তখনই নির্ভরসা হইয়া বলিল, “কিন্তু আমার প্রাণ-রক্ষায় আর এক অমঙ্গল আছে।”

ব্র। কি?

প্র। এ কথা তোমায় বলিব না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন আর না বলিলে নয়। এই সিপাহীদের সঙ্গে আমার শ্বশুর আছেন। আমি ধরা না পড়িলে তাঁর বিপদ ঘটিলেও ঘটিতে পারে।

ব্রজেশ্বর শিহরিল–মাথায় করাঘাত করিল। বলিল, “তিনিই কি গোইন্দা?”

প্রফুল্ল চুপ করিয়া রহিল। ব্রজেশ্বরের বুঝিতে কিছু বাকি রহিল না। এখানে আজিকার রাত্রে যে দেবী চৌধুরাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে, এ কথা হরবল্লভ ব্রজেশ্বরের কাছে শুনিয়াছিলেন। ব্রজেশ্বর আর কাহারও কাছে এ কথা বলেন নাই; দেবীরও যে গূঢ় মন্ত্রণা, আর কাহারও জানিবার সম্ভাবনা নাই। বিশেষ দেবী এ ঘাটে আসিবার আগেই কোম্পানীর সিপাহী রঙ্গপুর হইতে যাত্রা করিয়াছিল, সন্দেহ নাই; নহিলে ইহারই মধ্যে পৌঁছিত না। আর ইতিপূর্বেই হরবল্লভ কোথায় যাইতেছেন, কাহারও কাছে প্রকাশ না করিয়া দূরযাত্রা করিয়াছেন, আজও ফেরেন নাই। কথাটা বুঝিতে দেরী হইল না। তাই হরবল্লভ টাকা পরিশোধের কোন উদ্যোগ করেন নাই। তথাপি ব্রজেশ্বর ভুলিলেন না যে,
“পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতার প্রীতিমাপন্নে পীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।।”

ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে বলিলেন, “আমি মরি কোন ক্ষতি নাই। তুমি মরিলে, আমার মরার অধিক হইবে, কিন্তু আমি দেখিতে আসিব না। তোমার আত্মরক্ষার আগে, আমার ছার প্রাণ রাখিবার আগে, আমার পিতাকে রক্ষা করিতে হইবে।”

প্র। সে জন্য চিন্তা নাই। আমার রক্ষা হইবে না, অতএব তাঁর কোন ভয় নাই। তিনি তোমায় রক্ষা করিলে করিতে পারিবেন। তবে ইহাও তোমার মনস্তুষ্টির জন্য আমি স্বীকার করিতেছি যে, তাঁর অমঙ্গল সম্ভাবনা থাকিতে, আমি আত্মরক্ষার কোন উপায় করিব না। তুমি বলিলেও করিতাম না, না বলিলেও করিতাম না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকিও।

এই কথা দেবী আন্তরিক বলিয়াছিল। হরবল্লভ প্রফুল্লের সর্বনাশ করিয়াছিল, হরবল্লভ এখন দেবীর সর্বনাশ করিতে নিযুক্ত। তবু দেবী তাঁর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী। কেন না, প্রফুল্ল নিষ্কাম। যার ধর্ম নিষ্কাম, সে কার মঙ্গল খুঁজিলাম, তত্ত্ব রাখে না। মঙ্গল হইলেই হইল।

কিন্তু এ সময়ে তীরবর্তী অরণ্যমধ্য হইতে গভীর তূর্যধ্বনি হইল। দুই জনেই চমকিয়া উঠিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

দেবী ডাকিল, “নিশি!”

নিশি ছাদের উপর আসিল।

দেবী। কার ভেরী ঐ?

নি। যেন দাড়ি বাবাজীর বলিয়া বোধ হয়।

দেবী। রঙ্গরাজের?

নি। সেই রকম।

দেবী। সে কি? আমি রঙ্গরাজকে প্রাতে দেবীগড় পাঠাইয়াছি।

নি। বোধ হয়, পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে।

দেবী। রঙ্গরাজকে ডাক।

ব্রজেশ্বর বলিল, “ভেরীর আওয়াজ অনেক দূর হইতে হইয়াছে। এখান হইতে ডাকিলে ডাক শুনিতে পাইবে না। আমি নামিয়া ভেরীওয়ালাকে খুঁজিয়া আনিতেছি।”

দেবী বলিল, “কিছু করিতে হইবে না। তুমি একটু নীচে গিয়া নিশির কৌশল দেখ।”

নিশি ও ব্রজ নীচে আসিল। নিশি নীচে গিয়া এ বাঁশী বাহির করিল। নিশি গীত বাদ্যে বড় পটু, সে শিক্ষা রাজবাড়ীতে হইয়াছিল। নিশিই দেবীর বীণার ওস্তাদ। নিশি বাঁশীতে ফুঁ দিয়া মল্লারে তান মারিল। অনতিবিলম্বে রঙ্গরাজ বজরায় আসিয়া উঠিয়া দেবীকে আশীর্বাদ করিল।

এই সময়ে ব্রজেশ্বর নিশিকে বলিল, “তুমি ছাদে যাও। তোমার কাছে কেহ বোধ হয়, কথা লুকাইবে না। কি কথা হয়, শুনিয়া আসিয়া আমাকে সব বলিও।”

নিশি স্বীকৃত হইয়া কামরার বাহির হইল–বাহির হইয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “আপনি একটু বাহিরে আসিয়া দেখুন।”

ব্রজেশ্বর মুখ বাড়াইয়া দেখিল। দেখিতে পাইল, জঙ্গলের ভিতর হইতে অগণিত মনুষ্য বাহির হইতেছে। নিশিকে জিজ্ঞাসা করিল, “উহারা কারা? সিপাই?”

নিশি বলিল, “বোধ হয় উহারা বরকউন্দাজ। রঙ্গরাজ আনিয়া থাকিবে।”

দেবীও সেই মনুষ্যশ্রেণী দেখিতেছিল, এমন সময়ে রঙ্গরাজ আসিয়া আশীর্বাদ করিল। দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এখানে কেন রঙ্গরাজ?”

রঙ্গরাজ প্রথমে কোন উত্তর করিল না। দেবী পুনরপি বলিল, “আমি সকালে তোমাকে দেবীগড় পাঠাইয়াছিলাম। সেখানে যাও নাই কেন? আমার কথা অমান্য করিয়াছ কেন?”

র। আমি দেবীগড় যাইতেছিলাম –পথে ঠাকুরজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল।

দেবী। ভবানী ঠাকুর?

র। তাঁর কাছে শুনিলাম, কোম্পানির সিপাহী আপনাকে ধরিতে আসিতেছে। তাই আমরা দুই জনে বরকরন্দাজ সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিয়াছি। বরকহন্দাজ জঙ্গলে লুকাইয়া রাখিয়া আমি তীরে বসিয়াছিলাম। ছিপ আসিতেছে দেখিয়া আমি ভেরী বাজাইয়া সঙ্কেত করিয়াছি।

দেবী। ও জঙ্গলেও সিপাহী আছে?

র। তাহাদের আমরা ঘেরিয়া ফেলিয়াছি।

দেবী। ঠাকুরজি কোথায়?

র। ঐ বরকন্দাজ লইয়া বাহির হইতেছেন।

দেবী। তোমরা কত বরকন্দাজ আনিয়াছ?

র। প্রায় হাজার হইবে।

দেবী। সিপাহী কত?

র। শুনিয়াছি পাঁচ শ।
দেবী। এই পনের শ লোকের লড়াই হইলে, মরিবে কত?

র। তা দুই চারি শ মরিলেও মরিতে পারে।

দেবী। ঠাকুরজিকে গিয়া বল–তুমিও শোন যে, তোমাদের এই আচরণে আমি আজ মর্মান্তিক মনঃপীড়া পাইলাম।

র। কেন, মা?

দেবী। একটা মেয়েমানুষের প্রাণের জন্য এত লোক তোমরা মারিবার বাসনা করিয়াছ–তোমাদের কি কিছু ধর্মজ্ঞান নাই? আমার পরমায়ু শেষ হইয়া থাকে, আমি একা মরিব– আমার জন্য চারি শ লোক কেন মরিবে? আমায় কি তোমরা এমন অপদার্থ ভাবিয়াছ যে, আমি এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিয়া আপনার প্রাণ বাঁচাইব?

র। আপনি বাঁচিলে অনেক লোকের প্রাণরক্ষা হইবে।

দেবী রাগে, ঘৃণায় অধীর হইয়া বলিল, “ছি! সেই ধিক্কারে রঙ্গরাজ অধোবদন হইল–মনে করিল, “পৃথিবী দ্বিধা হউক, আমি প্রবেশ করি।”

দেবী তখন বিস্ফারিত নয়নে, ঘৃণাস্ফুরিত কম্পিতাধরে বলিতে লাগিল, “শোন, রঙ্গরাজ! ঠাকুরজিকে গিয়া বল, এই মুহূর্ত্তে বরকন্দাজ সকল ফিরাইয়া লইয়া যাউন। তিলার্দ্ধ বিলম্ব হইলে, আমি এই জলে ঝাঁপ দিয়া মরিব, তোমরা কেহ রাখিতে পারিবে না।”

রঙ্গরাজ এতটুকু হইয়া গেল। বলিল, “আমি চলিলাম। ঠাকুরজিকে এই সকল কথা জানাইব। তিনি যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহা করিবেন। আমি উভয়েরই আজ্ঞাকারী।”

রঙ্গরাজ চলিয়া গেল। নিশি ছাদে দাঁড়াইয়া সব শুনিয়াছিল। রঙ্গরাজ গেলে, সে দেবীকে বলিল, “ভাল, তোমার প্রাণ লইয়া তুমি যাহা ইচ্ছা করিতে পার, তাহারও নিষেধ করিবার অধিকার নাই। কিন্তু আজি তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী–তাঁর জন্যেও ভাবিলে না?”

দেবী। ভাবিয়াছি ভগিনি! ভাবিয়া কিছু করিতে পারি নাই। জগদীশ্বর মাত্র ভরসা। যা হইবার, হইবে। কিন্তু যাই হউক নিশি–এক কথা সার। আমার স্বামীর প্রাণ বাঁচাইবার জন্য এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিবার আমার কোন অধিকার নাই। আমার স্বামী আমার বড় আদরের–তাদের কে?

নিশি মনে মনে দেবীকে ধন্য ধন্য করিল। ভাবিল, “এই সার্থক নিষ্কাম ধর্ম শিখিয়াছিল। ইহার সঙ্গে মরিয়াও সুখ।”

নিশি গিয়া, সকল কথা ব্রজেশ্বরকে শুনাইল। ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে আর আপনার স্ত্রী বলিয়া ভাবিতে পারিল না; মনে মনে বলিল, “যথার্থ দেবীই বটে। আমি নরাধম! আমি আবার ইহাকে ডাকাইত বলিয়া ভর্ৎসনা করিতে গিয়াছিলাম।”

এদিকে পাঁচ দিক হইতে পাঁচখানা ছিপ আসিয়া বজরার অতি নিকটবর্তী হইল। প্রফুল্ল সেদিকে দৃকপাতও করিল না, প্রস্তরময়ী মূর্ত্তির মত নিস্পন্দ শরীরে ছাদের উপর বসিয়া রহিল। প্রফুল্ল ছিপ দেখিতেছিল না–বর্ককন্দাজ দেখিতেছিল না। দূর আকাশপ্রান্তে তাহার দৃষ্টি। আকাশপ্রান্তে একখানা ছোট মেঘ, অনেক ক্ষণ হইতে দেখা দিয়াছিল। প্রফুল্ল তাই দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে বোধ হইল, যেন সেখানা একটু বাড়িল; তখন “জয় জগদীশ্বর!” বলিয়া প্রফুল্ল ছাদ হইতে নামিল।

প্রফুল্লকে ভিতরে আসিতে দেখিয়া, নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “এখন কি করিবে?”

প্রফুল্ল বলিল, “আমার স্বামীকে বাঁচাইব।”

নি। আর তুমি?

দেবী। আমার কথা আর জিজ্ঞাসা করিও না। আমি যাহা বলি, যাহা করি, এখন তাহাতে বড় সাবধানে মনোযোগ দাও। তোমার আমার অদৃষ্টে যাই হৌক, আমার স্বামীকে বাঁচাইতে হইবে, দিবাকে বাঁচাইতে হইবে, শ্বশুরকে বাঁচাইতে হইবে।

এই বলিয়া দেবী একটা শাঁক লইয়া ফুঁ দিল। নিশি বলিল, “তবু ভাল।”

দেবী বলিল, “ভাল কি মন্দ, বিবেচনা করিয়া দেখ। যাহা যাহা করিতে হইবে, তোমাকে বলিয়া দিতেছি। তোমার উপর সব নির্ভর।”

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পিপীলিকাশ্রেণীবৎ বরকন্দাজের দল ত্রিস্রোতার তীর-বন সকল হইতে বাহির হইতে লাগিল। মাথায় লাল পাগড়ি, মালকোঁচামারা, খালি পা–জলে লড়াই করিতে হইবে বলিয়া কেহ জুতা আনে নাই। সবার হাতে ঢাল-সড়কি–কাহারও কাহারও বন্দুক আছে–কিন্তু বন্দুকের ভাগ অল্প। সকলেরই পিঠে লাঠি বাঁধা–এই বাঙ্গালার জাতীয় হাতিয়ার। বাঙ্গালী ইহার প্রকৃত ব্যবহার জানিত; লাঠি ছাড়িয়াই বাঙ্গালী নির্জীব হইয়াছে।

বরকন্দাজেরা দেখিল, ছিপগুলি প্রায় আসিয়া পড়িয়াছে–বজরা ঘেরিবে! বরকন্দাজ দৌড়াইল–“রাণীজি-কি জয়” বলিয়া তাহারাও বজরা ঘেরিতে চলিল। তাহারা আসিয়া আগে বজরা ঘেরিল–ছিপ তাহাদের ঘেরিল। আর যে সময়ে শাঁক বাজিল, ঠিক সেই সময়ে জন কত বরকন্দাজ আসিয়া বজরার উপর উঠিল। তাহারা বজরার মাঝি-মাল্লা–নৌকার কাজ করে, আবশ্যকমত লাঠি-সড়কিও চালায়। তাহারা আপাততঃ লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হইবার কোন ইচ্ছা দেখাইল না। দাঁড়ে হালে, পালের রসি ধরিয়া, লগি ধরিয়া, যাহার যে স্থান, সেইখানে বসিল। আরও অনেক বরকন্দাজ বজরায় উঠিল। তিন চারি শ বরকন্দাজ তীরে রহিল–সেইখান হইতে ছিপের উপর সড়কি চালাইতে লাগিল। কতক সিপাহী ছিপ হইতে নামিয়া, বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইযা তাহাদের আক্রমণ করিল। যে বরকন্দাজেরা বজরা ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অবশিষ্ট সিপাহীরা তাহাদের উপর পড়িল। সর্বত্র হাতাহাতি লড়াই হইতে লাগিল। তখন মারামারি, কাটাকাটি, চেঁচাচেঁচি, বন্দুকের হুড়মুড়, লাঠির ঠক্ঠতকি, ভারি হুলস্থূল পড়িয়া গেল; কেহ কাহারও কথা শুনিতে পায় না–কেহ কোন স্থানে স্থির হইতে পারে না।

দূর হইতে লড়াই হইলে সিপাহীর কাছে লাঠিয়ালেরা অধিকক্ষণ টিকিত না–কেন না, দূরে লাঠি চলে না। কিন্তু ছিপের উপর থাকিতে হওয়ায় সিপাহীদের বড় অসুবিধা হইল। যাহারা তীরে উঠিয়া যুদ্ধ করিতেছিল, সে সিপাহীরা লাঠিয়ালদিগকে সঙ্গীনের মুখে হটাইতে লাগিল, কিন্তু যাহারা জল লড়াই করিতেছিল, তাহারা বরকন্দাজদিগের লাঠি-সড়কিতে হাত পা বা মাথা ভাঙ্গিয়া কাবু হইতে লাগিল।

প্রফুল্ল নীচে আসিবার অল্পমাত্র পরেই এই ব্যাপার আরম্ভ হইল। প্রফুল্ল মনে করিল, “হয় ভবানী ঠাকুরের কাছে আমার কথা পৌঁছে নাই–নয় তিনি আমার কথা রাখিলেন না; মনে করিয়াছেন, আমি মরিতে পারিব না। ভাল, আমার কাজটাই তিনি দেখুন।”

দেবীর রাণীগিরিতে গুটিকতক চমৎকার গুণ জন্মিয়াছিল। তার একটি এই যে, যে সামগ্রীর কোন প্রকার প্রয়োজন হইতে পারে, তাহা আগে গুছাইয়া হাতের কাছে রাখিতেন। এ গুণের পরিচয় অনেক পাওয়া গিয়াছে। দেবী এখন হাতের কাছেই পাইলেন–একটা সাদা নিশান। সাদা নিশানটি বাহিরে লইয়া গিয়া স্বহস্তে উঁচু করিয়া ধরিলেন।

সেই নিশান দেখিবামাত্র লড়াই একেবারে বন্ধ হইল। যে যেখানে ছিল, সে সেইখানেই হাতিয়ার ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ঝড় তুফান যেন হঠাৎ থামিয়া গেল, প্রমত্ত সাগর যেন অকস্মাৎ প্রশান্ত হ্রদে পরিণত হইল।

দেবী দেখিল, পাশে ব্রজেশ্বর। এই যুদ্ধের সময়ে দেবীকে বাহিরে আসিতে দেখিয়া, ব্রজেশ্বরও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। দেবী তাঁহাকে বলিল, “তুমি এই নিশান এইরূপ ধরিয়া থাক। আমি ভিতরে গিয়া নিশি ও দিবার সঙ্গে একটা পরামর্শ আঁটিব। রঙ্গরাজ যদি এখানে আসে, তাহাকে বলিও, সে দরওয়াজা হইতে আমার হুকুম লয়।”
এই বলিয়া দেবী ব্রজেশ্বরের হাতে নিশান দিয়া চলিয়া গেল। ব্রজেশ্বর নিশান তুলিয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ইতিমধ্যে সেখানে রঙ্গরাজ আসিয়া উপস্থিত হইল। রঙ্গরাজ ব্রজেশ্বরের হাতে সাদা নিশান দেখিয়া, চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “তুমি কার হুকুমে সাদা নিশান দেখাইলে?”

ব্র। রাণীজির হুকুম।

র। রাণীজির হুকুম? তুমি কে?

ব্র। চিনিতে পার না?

রঙ্গরাজ একটু নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “চিনিয়াছি। তুমি ব্রজেশ্বরবাবু? এখানে কি মনে করে? বাপ-বেটায় এক কাজে না কি? কেহ একে বাঁধ।”

রঙ্গরাজের ধারণা হইল যে, হরবল্লভের ন্যায় দেবীকে ধরাইয়া দিবার জন্যই ব্রজেশ্বর কোন ছলে বজরায় প্রবেশ করিয়াছে। তাহার আজ্ঞা পাইয়া দুই জন ব্রজেশ্বরকে বাঁধিতে আসিল। ব্রজেশ্বর কোন আপত্তি করিলেন না, বলিলেন, “আমায় বাঁধ, তাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু একটা কথা বুঝাইয়া দাও। সাদা নিশান দেখিয়াই দুই দলে যুদ্ধ বন্ধ করিল কেন?”

রঙ্গরাজ বলিল, “কচি খোকা আর কি? জান না, সাদা নিশান দেখাইলে ইংরেজের আর যুদ্ধ করিতে নাই?”

ব্র। তা আমি জানিতাম না। তা আমি জানিয়াই করি, আর না জানিয়াই করি, রাণীজির হুকুম মত সাদা নিশান দেখাইয়াছি কি না, তুমি না হয় জিজ্ঞাসা করিয়া আইস। আর তোমায়ও আজ্ঞা আছে যে, তুমি দরওয়াজা হইতে রাণীজির হুকুম লইবে।

রঙ্গরাজ বরাবর কামরার দরজায় গেল। কামরার দরজা বন্ধ আছে দেখিয়া বাহির হইতে ডাকিল, “রাণী মা!”

ভিতর হইতে উত্তর, “কে, রঙ্গরাজ?”

র। আজ্ঞা হাঁ–একটা সাদা নিশান আমাদের বজরা হইতে দেখান হইয়াছে–লড়াই সেই জন্য বন্ধ আছে।

ভিতর হইতে–“সে আমার হুকুম মত হইয়াছে। এখন তুমি ঐ সাদা নিশান লইয়া লেফটেনান্ট সাহেবের কাছে যাও। গিয়া বল যে, লড়াইয়ে প্রয়োজন নাই, আমি ধরা দিব।”

র। আমার শরীর থাকিতে তাহা কিছুতেই হইবে না।

দেবী। শরীরপাত করিয়াও আমায় রক্ষা করিতে পারিবে না।

র। তথাপি শরীরপাত করিব।

দেবী। শোন, মূর্খের মত গোল করিও না। তোমরা প্রাণ দিয়া আমায় বাঁচাইতে পারিবে না–এ সিপাহীর বন্দুকের কাছে লাঠি সোঁটা কি করিবে?

র। কি না করিবে?

দেবী। যাই করুক–আর এক বিন্দু রক্তপাত হইবার আগে আমি প্রাণ দিব,-বাহিরে গিয়া গুলির মুখে দাঁড়াইব–রাখিতে পারিবে না। বরং এখন আমি ধরা দিলে, পলাইবার ভরসা রহিল। বরং এক্ষণে আপন আপন প্রাণ রাখিয়া সুবিধা মত যাহাতে আমি বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারি, সে চেষ্টা করিও। আমার অনেক টাকা আছে। কোম্পানির লোক সকল অর্থের বশ–আমার পলাইবার ভাবনা কি?
দেবী মুহূর্ত জন্যও মনে করেন নাই যে, ঘুষ দিয়া তিনি পলাইবেন। সে রকম পলাইবার ইচ্ছাও ছিল না। এ কেবল রঙ্গরাজকে ভুলাইতেছিলেন। তাঁর মনের ভিতর যে গভীর কৌশল উদ্ভাবিত হইয়াছিল, রঙ্গরাজের বুঝিবার সাধ্য ছিল না–সুতরাং রঙ্গরাজকে তাহা বুঝাইলেন না। সরলভাবে ইংরেজকে ধরা দিবেন, ইহা স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহাও বুঝিয়াছিলেন যে, ইংরেজ আপনার বুদ্ধিতে সব খোয়াইবে। ইহাও স্থির করিয়াছিলেন যে, শত্রুর অনিষ্ট করিবেন না, বরং শত্রুকে সতর্ক করিয়া দিবেন। তবে স্বামী, শ্বশুর, সখীদিগের উদ্ধারের জন্য যাহা অবশ্য কর্তব্য, তাহাও করিবেন; যাহা যাহা হইবে, দেবী যেন দর্পণের ভিতর সকল দেখিতে পাইতেছিলেন।

রঙ্গরাজ বলিল, “যাহা দিয়া কোম্পানীর লোক বশ করিবেন, তাহা ত বজরাতেই আছে। আপনি ধরা দিলে, ইংরেজ বজরাও লইবে।”

দেবী। সেইটি নিষেধ করিও। বলিও যে, আমি ধরা দিব, কিন্তু বজরা দিব না; বজরায় যাহা আছে, তাহার কিছুই দিব না; বজরায় যাহা আছে, তাহাদের কাহাকেও তিনি ধরিতে পারিবেন না। এই নিয়মে আমি ধরা দিতে রাজি।

র। ইংরেজ যদি না শুনে, যদি বজরা লুঠিতে আসে।

দেবী। বারণ করিও–বজরায় না আসে, বজরা না স্পর্শ করে। বলিও যে, তাহা করিলে ইংরেজের বিপদ ঘটিবে। বজরায় আসিলে আমি ধরা দিব না। যে মুহূর্তে ইংরেজ বজরায় উঠিবে, সেই দণ্ডে আবার যুদ্ধ আরম্ভ জানিবেন। আমার কথায় তিনি স্বীকৃত হইলে, তাঁহাদের কাহাকে এখানে আসিতে হইবে না। আমি নিজে তাঁহার ছিপে যাইব।

রঙ্গরাজ বুঝিল, ভিতরে একটা কি গভীর কৌশল আছে। দৌত্যে স্বীকৃত হইল। তখন দেবী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভবানী ঠাকুর কোথায়?”

র। তিনি তীরে বরকন্দাজ লইয়া যুদ্ধ করিতেছেন। আমার কথা শোনেন নাই। বোধ করি, এখনও সেইখানে আছেন।

দেবী। আগে তাঁর কাছে যাও। সব বরকন্দাজ লইয়া নদীর তীরে তীরে স্বস্থানে যাইতে বল। বলিও যে, আমার বজরার লোকগুলি রাখিয়া গেলেই যথেষ্ট হইবে। আর বলিও যে, আমার রক্ষার জন্য আর যুদ্ধের প্রয়োজন নাই–আমার রক্ষার জন্য ভগবান উপায় করিয়াছেন। ইহাতে যদি তিনি আপত্তি করেন, আকাশ পানে চাহিয়া দেখিতে বলিও– তিনি বুঝিতে পারিবেন।

রঙ্গরাজ তখন স্বয়ং আকাশ পানে চাহিয়া দেখিল–দেখিল, বৈশাখী নবীন নীরদমালায় গগন অন্ধকার হইয়াছে।

রঙ্গরাজ বলিল, “মা! আর একটা আজ্ঞার প্রার্থনা করি। হরবল্লভ রায় আজিকার গোইন্দা। তার ছেলে ব্রজেশ্বরকে নৌকায় দেখিলাম। অভিপ্রায়টা মন্দ, সন্দেহ নাই। তাহাকে বাঁধিয়া রাখিতে চাহি।”

শুনিয়া নিশি ও দিবা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। দেবী বলিল, “বাঁধিও না। এখন গোপনে ছাদের উপর বসিয়া থাকিতে বল। পরে যখন দিবা নামিতে হুকুম দিবে, তখন নামিবেন।”

আজ্ঞামত রঙ্গরাজ আগে বজ্রেশ্বরকে ছাদে বসাইল। তার পর ভবানী ঠাকুরের কাছে গেল, এবং দেবী যাহা বলিতে বলিয়াছিলেন, তাহা বলিল। রঙ্গরাজ মেঘ দেখাইল–ভবানী দেখিল। ভবানী আর আপত্তি না করিয়া, তীরের ও জলের বরকন্দাজ সকল জমা করিয়া লইয়া ত্রিস্রোতার তীরে তীরে স্বস্থানে যাইবার উদ্যোগ করিল।

এদিকে দিবা ও নিশি, এই অবসরে বাহিরে আসিয়া, বরকন্দাজবেশী দাঁড়ী-মাঝিদিগকে চুপি চুপি কি বলিয়া গেল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

এদিকে ভবানী ঠাকুরকে বিদায় দিয়া, রঙ্গরাজ সাদা নিশান হাতে করিয়া, জলে নামিয়া লেফটেনাণ্ট সাহেবের ছিপে গিয়া উঠিল। সাদা নিশান হাতে দেখিয়া কেহ কিছু বলিল না। সে ছিপে উঠিলে সাহেব তাহাকে বলিলেন, “তোমরা সাদা নিশান দেখাইয়াছ, ধরা দিবে?”

র। আমরা ধরা দিব কি? যাঁহাকে ধরিতে আসিয়াছেন, তিনিই ধরা দিবেন, সেই কথা বলিতে আসিয়াছি।

সাহেব। দেবী চৌধুরাণী ধরা দিবেন?

র। দিবেন। তাই বলিতে আমাকে পাঠাইয়াছেন।

সা। আর তোমরা?

র। আমরা কারা?

সা। দেবী চৌধুরাণীর দল।

র। আমরা ধরা দিব না।

সা। আমি দলশুদ্ধ ধরিতে আসিয়াছি।

র। এই দল কারা? কি প্রকারে এই হাজার বরকন্দাজের মধ্যে দল বেদল চিনিবেন?

যখন রঙ্গরাজ এই কথা বলিল, তখন ভবানী ঠাকুর বরকন্দাজ সৈন্য লইয়া চলিয়া যান নাই। যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। সাহেব বলিল, “এই হাজার বরকন্দাজ সব সবাই ডাকাইত; কেন না, উহারা ডাকাইতের হইয়া সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে।”

র। উহারা যুদ্ধ করিবে না, চলিয়া যাইতেছে দেখুন।

সাহেব দেখিলেন, বরকন্দাজ সৈন্য পলাইবার উদ্যোগ করিতেছে। সাহেব তর্জন গর্জন করিয়া বলিলেন, “কি! তোমরা সাদা নিশানের ভাণ করিয়া পলাইতেছ?”

রঙ্গরাজ। সাহেব, ধরিলে কবে যে পলাইলাম?

এখনও সিপাহীরা সাহেবের আজ্ঞা না পাইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল।

সাহেব ভাবিতেছিলেন, “উহাদের পশ্চাদ্ধাবিত হওয়া বৃথা। পিছু ছুটিতে ছুটিতে উহারা নিবিড় জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিবে। একে রাত্রিকাল, তাহাতে মেঘাড়ম্বর, জঙ্গলে ঘোর অন্ধকার সন্দেহ নাই। আমার সিপাহীরা পথ চেনে না, বরকন্দাজেরা পথ চেনে। সুতরাং তাহাদের ধরা সিপাহীর সাধ্য নহে।” কাজেই সাহেব সে অভিপ্রায় পরিত্যাগ করিলেন। বলিলেন, “যাক, উহাদের চাই না। যে কথা হইতেছিল, তাই হৌক, তোমরা সকলে ধরা দিবে?”

র। একজনও না। কেবল দেবী রাণী।

সা। পীষ্! এখন আর লড়াই করিবে কে? এই যে কয়জন, তাহারা কি আর পাঁচ শ সিপাহীর সঙ্গে লড়াই করিতে পারিবে? তোমার বরকন্দাজ সেনা ত জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল, দেখিতেছি।

রঙ্গরাজ দেখিল, বাস্তবিক ভবানী ঠাকুরের সেনা জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল।

রঙ্গরাজ বলিল, “আমি অত জানি না। আমায় আমাদের প্রভু যা বলিয়াছেন, তাহাই বলিতেছি। বজরা পাইবেন না, বজরার যে ধন তাহা পাইবেন না, আমাদের কাহাকেও পাইবেন না। কেবল দেবী রাণীকে পাইবেন।

সা। কেন?

র। তা জানি না।
সা। জান আর নাই জান, বজরা এখন আমার, আমি উহা দখল করিব।

র। সাহেব, বজরায় উঠিও না, বজরা ছুঁইও না, বিপদ ঘটিবে।

সা। পুঃ! পাঁচ শ সিপাহী লইয়া তোমাদের জন দুই চারি লোকের কাছে বিপদ!

এই বলিয়া সাহেব সাদা নিশান ফেলিয়া দিলেন। সিপাহীদের হুকুম দিলেন, “বজরা ঘেরাও কর।”

সিপাহীরা পাঁচখানা ছিপ সমেত বজরা ঘেরিয়া ফেলিল। তখন সাহেব বলিলেন, “বজরার উপর উঠিয়া বরকন্দাজদিগের অস্ত্র কাড়িয়া লও”।

এ হুকুম সাহেব উচ্চৈঃস্বরে দিলেন। কথা দেবীর কাণে গেল। দেবীও বজরার ভিতর হইতে উচ্চৈঃস্বরে হুকুম দিলেন, “বজরায় যাহার যাহার হাতে হাতিয়ার আছে, সব জলে ফেলিয়া দাও।”

শুনিবামাত্র, বজরায় যাহার যাহার হাতে অস্ত্র ছইল, সব জলে ফেলিয়া দিল। রঙ্গরাজও আপনার অস্ত্র সকল জলে ফেলিয়া দিল। দেখিয়া সাহেব সন্তুষ্ট হইলেন, বলিলেন, “চল, এখন বজরায় গিয়া দেখি, কি আছে?”

র। সাহেব, আপনি জোর করিয়া বজরায় যাইতেছেন, আমার দোষ নাই।

সা। তোমার আবার দোষ কি?

এই বলিয়া সাহেব একজন মাত্র সিপাহী সঙ্গে লইয়া সশস্ত্রে বজরায় উঠিলেন। এটা বিশেষ সাহসের কাজ নহে; কেন না, বজরার উপর যে কয়জন লোক ছিল, তাহারা সকলেই অস্ত্র ত্যাগ করিয়াছে। সাহেব বুঝেন নাই যে, দেবীর স্থিরবুদ্ধিই শাণিত মহাস্ত্র; তার অন্য অস্ত্রের প্রয়োজন নাই।

সাহেব রঙ্গরাজের সঙ্গে কামরার দরজায় আসিলেন। দ্বার তৎক্ষণাৎ মুক্ত হইল। উভয়ে ভিতরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে দুই জনেই বিস্মিত হইলেন।

দেখিলেন, যে দিন প্রথম ব্রজেশ্বর বন্দী হইয়া এই ঘরে প্রবেশ করিয়াছিলেন, সে দিন যেমন ইহার মনোহর সজ্জা, আজিও সেইরূপ; দেয়ালে তেমনি চারু চিত্র। তেমনি সুন্দর গালিচা পাতা। তেমনি আতরদান, গোলাবপাশ, তেমনি সোণার পুষ্পপাত্রে ফুল ভরা, সোণার আলবোলায় তেমনি মৃগনাভিগন্ধি তামাকু সাজা। তেমনি রূপার পুতুল, রূপার ঝাড়, সোণার শিকলে দোলান সোণার প্রদীপ। কিন্তু আজ একটা মসনদ নয়–দুইটা। দুইটা মসনদের উপর সুবর্ণমণ্ডিত উপাধানে দেহ রক্ষা করিয়া দুইটি সুন্দরী রহিয়াছে। তাহাদের পরিধানে মহার্ঘ বস্ত্র, সর্বাঙ্গে মহামূল্য রত্নভূষা। সাহেব তাদের চেনে না–রঙ্গরাজ চিনিল। চিনিল যে, একজন নিশি–আর একজন দিবা।

সাহেবের জন্য একখানা রূপার চৌকি রাখা হইয়াছিল, সাহেব তাহাতে বসিলেন। রঙ্গরাজ খুঁজিতে লাগিলেন, দেবী কোথা? দেখিলেন, কামরার এক ঘরে দেবীর সহজ বেশে দেবী দাঁড়াইয়া আছে, গড়া পরা, কেবল কড় হাতে, এলোচুল, কোন বেশভূষা নাই।

সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে দেবী চৌধুরাণী? কাহার সঙ্গে কথা কহিব?”

নিশি বলিল, “আমার সঙ্গে কথা কহিবেন। আমি দেবী।”

দিবা হাসিল, বলিল, “ইংরেজ দেখিয়া রঙ্গ করিতেছিস? এ কি রঙ্গের সময়? লেফটেনান্ট সাহেব! আমার এ ভগিনী কিছু রঙ্গ-তামাশা ভালবাসে, কিন্তু এ তার সময় নয়। আপনি আমার সঙ্গে কথা কহিবেন–আমি দেবী চৌধুরাণী।”

নিশি বলিল, “আ মরণ! তুই কি আমার জন্য ফাঁসি যেতে চাস না কি?” সাহেবের দিকে ফিরিয়া নিশি বলিল, “সাহেব, ও আমার ভগিনী–বোধ হয়, স্নেহবশতঃ আমাকে রক্ষা করিবার জন্য আপনাকে প্রতারণা করিতেছে। কিন্তু কেমন করিয়া মিথ্যা প্রবঞ্চনা করিয়া, বহিনের প্রাণদণ্ড করিয়া, আপনার প্রাণ রক্ষা করিব? প্রাণ অতি তুচ্ছ, আমরা বাঙ্গালীর মেয়ে, অক্লেশে ত্যাগ করিতে পারি। চলুন, আমাকে কোথায় লইয়া যাইবেন, যাইতেছি। আমিই দেবী রাণী।”
দিবা বলিল, “সাহেব! তোমার যিশুখ্রীষ্টের দিব্য, তুমি যদি নিরপরাধিনীকে ধরিয়া লইয়া যাও। আমি দেবী।”

সাহেব বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি তামাশা? কে দেবী চৌধুরাণী, তুমি যথার্থ বলিবে?”

রঙ্গরাজ কিছু বুঝিল না, কেবল অনুভব করিল যে, ভিতরে একটা কি কৌশল আছে। অতএব বুদ্ধি খাটাইয়া সে নিশিকে দেখাইয়া, হাতজোড় করিয়া বলিল, “হুজুর! এ-ই যথার্থ দেবী রাণী।”

তখন দেবী প্রথম কথা কহিল। বলিল, “আমার ইহাতে কথা কহা বড় দোষ। কিন্তু কি জানি, এর পর মিছা কথা ধরা পড়িলে, যদি সকলে মারা যায়, তাই বলিতেছি, এ ব্যক্তি যাহা বলিতেছে, তাহা সত্য নহে।” পরে নিশিকে দেখাইয়া বলিল, “এ দেবী নহে। যে উহাকে দেবী বলিয়া পরিচয় দিতেছে, সে রাণীজিকে মা বলে, রাণীজিকে মার মত ভক্তি করে, এই জন্য সে রাণীজিকে বাঁচাইবার জন্য অন্য ব্যক্তিকে নিশান দিতেছে।”

তখন সাহেব দেবীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দেবী তবে কে?”

দেবী বলিল, “আমি দেবী।”

দেবী এই কথা বলিলে নিশিতে, দিবাতে, রঙ্গরাজে ও দেবীতে বড় গণ্ডগোল বাধিয়া গেল। নিশি বলে, “আমি দেবী,” দিবা বলে, “আমি দেবী,” রঙ্গরাজ নিশিকে বলে, “এই দেবী,” দেবী বলে, “আমি দেবী।” বড় গোলমাল।

তখন লেফটেনান্ট সাহেব মনে করিলেন, এ ফেরেববাওজির একটা চূড়ান্ত করা উচিত। বলিলেন, “তোমাদের দুই জনের মধ্যে একজন দেবী চৌধুরাণী বটে। ওটা চাকরাণী, ওটা দেবী নহে। এই দুই জনের মধ্যে কে সে পাপিষ্ঠা, তাহা তোমরা চাতুরী করিয়া আমাকে জানিতে দিতেছ না। ইহার পর প্রমাণের দ্বারা যে দেবী চৌধুরাণী বলিয়া সাব্যস্ত হইবে, সেই ফাঁসি যাইবে। যদি প্রমাণের দ্বারা এ কথা পরিষ্কার না হয়, তবে দুই জনের ফাঁসি যাইবে।”

তখন নিশি ও দিবা দুই জনেই বলিল, “এত গোলযোগে কাজ কি? আপনার সঙ্গে কি গোইন্দা নাই? যদি গোইন্দা থাকে, তবে তাহাকে ডাকালেই ত সে বলিয়া দিতে পারিবে, –কে যথার্থ দেবী চৌধুরাণী।”

হরবল্লভকে বজরায় আনিবে, দেবীর এই প্রধান উদ্দেশ্য। হরবল্লভের রক্ষার ব্যবস্থা না করিয়া, দেবী আত্মরক্ষার উপায় করিবে না, ইহা স্থির। তাঁহাকে বজরায় না আনিতে পারিলে হরবল্লভের রক্ষার নিশ্চয়তা হয় না।

সাহেব মনে করিলেন, “এ পরামর্শ মন্দ নহে।” তখন তাঁহার সঙ্গে যে সিপাহী আসিয়াছিল, তাহাকে বলিলেন, “গোইন্দাকে ডাক।” সিপাহী এক ছিপের একজন জমাদ্দার সাহেবকে ডাকিয়া বলিল, “গোইন্দাকে ডাক।” তখন গোইন্দাকে ডাকাডাকির গোল পড়িয়া গেল। গোইন্দা কোথায়, গোইন্দা কে, তাহা কেহই জানে না, কেবল চারি দিকে ডাকাডাকি করে।

সপ্তম পরিচ্ছেদ
বস্তুতঃ হরবল্লভ রায় মহাশয় যুদ্ধক্ষেত্রেই উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু সে ইচ্ছাপূর্বক নহে, ঘটনাবিহীন। প্রথমে বড় ঘেঁষেন নাই। “শৃঙ্গিণাং শস্ত্রপাণিনাং” ইত্যাদি চাণক্যপ্রদত্ত সদুপদেশ স্মরণ করিয়া তিনি সিপাহীদিগের ছিপে উঠেন নাই। একখানা পৃথক ডিঙ্গিতে থাকিয়া, লেফটেনান্ট সাহেবকে বজরা দেখাইয়া দিয়া, অর্ধ ক্রোশ দূরে পলাইয়া গিয়া ডিঙ্গি ও প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। তার পর দেখিলেন, আকাশের বড় ঘনঘটা। মনে করিলেন, ঝড় উঠিবে ও এখনই আমার ডিঙ্গি ডুবিয়া যাইবে, টাকার লোভে আসিয়া প্রাণ হারাইব–আমার সৎকারও হইবে না। তখন রায় মহাশয় ডিঙ্গি হইতে তীরে অবতরণ করিলেন। কিন্তু তীরে সেখানে কেহ কোথাও নাই দেখিয়া বড় ভয় হইল। সাপের ভয়, বাঘের ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়, ভূতের ভয়। হরবল্লভের মনে হইল, কেন এমন ঝকমাবরি করিতে আসিয়াছিলাম। হরবল্লভের কান্না আসিল।

এমন সময়ে হঠাৎ বন্দুকের হুড়মুড়ি, সিপাহী বরকন্দাজের হৈ হৈ শব্দ সব বন্ধ হইয়া গেল। হরবল্লভের বোধ হইল, অবশ্য সিপাহীর জয় হইয়াছে, ডাকাইত মাগী ধরা পড়িয়াছে, নহিলে লড়াই বন্ধ হইবে কেন? তখন হরবল্লভ ভরসা পাইয়া যুদ্ধস্থানে যাইতে অগ্রসর হইলেন। তবে এ রাত্রিকালে, এ অন্ধকারে, এ বন-জঙ্গলের মাঝে অগ্রসর হন কিরূপে? ডিঙ্গির মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ বাপু মাঝি, –বলি, ওদিকে যাওয়া যায় কিরূপে বলতে্ পার?”

মাঝি বলিল, “যাওয়ার ভাবনা কি? ডিঙ্গিতে উঠুন না, নিয়ে যাচ্ছি। সিপাহীরা মারবে ধরবে না ত? আবার যদি লড়াই বাধে?”

হ। সিপাহীরা আমাদের কিছু বলিবে না। লড়াই আর বাধিবে না–ডাকাইত ধরা পড়েছে। কিন্তু যে রকম মেঘ করেছে, এখনই ঝড় উঠবে–ডিঙ্গিতে উঠি কিরূপে?

মাঝি বলিল, “ঝড়ে ডিঙ্গি কখন ডুবে না।”

হরবল্লভ প্রথমে সে সকল কথায় বিশ্বাস করিলেন না–শেষ অগত্যা ডিঙ্গিতে উঠিলেন। মাঝিকে উপদেশ দিলেন, কেনারায় কেনারায় ডিঙ্গি লইয়া যাইবে। মাঝি তাহাই করিল। শীঘ্র আসিয়া ডিঙ্গি বজরায় লাগিল। হরবল্লভ সিপাহীদের সঙ্কেতবাক্য জানিতেন, সুতরাং সিপাহীরা আপত্তি করিল না। সেই সময়ে “গোইন্দা! গোইন্দা!” করিয়া ডাকাডাকি হইতেছিল। হরবল্লভ বজরায় উঠিয়া সম্মুখস্থ আরদালির সিপাহীকে বলিল, “গোইন্দাকে খুঁজিতেছ? আমি গোইন্দা।”

সিপাহী বলিল, “তোমাকে কাপ্তেন সাহেব তলব করিয়াছেন।”

হ। কোথায় তিনি?

সি। কামরার ভিতর। তুমি কামরার ভিতর যাও।

হরবল্লভ আসিতেছে জানিতে পারিয়া দেবী প্রস্থানের উদ্যোগ দেখিল। “কাপ্তেন সাহেবের জন্য কিছু জলযোগের উদ্যোগ দেখি” বলিয়া ভিতরের কামরায় চলিয়া গেল।

এদিকে হরবল্লভ কামরার দিকে গেলেন। কামরার দ্বারে উপস্থিত হইয়া কামরার সজ্জা ও ঐশ্বর্য, দিবা ও নিশির রূপ ও সজ্জা দেখিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন। সাহেবকে সেলাম করিতে গিয়া, ভুলিয়া নিশিকে সেলাম করিয়া ফেলিলেন। হাসিয়া নিশি কহিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! মেজাজ সরিফ্?”

শুনিয়া দিবা বলিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! আমায় একটা কুর্ণিশ হলো না–আমি হলেম এদের রাণী।”

সাহেব হরবল্লভকে বলিলেন, “ইহারা ফেরেব করিয়া দুই জনেই বলিতেছে, ‘আমি দেবী চৌধুরাণী।’ কে দেবী চৌধুরাণী, তাহার ঠিকানা না হওয়ায়, আমি তোমাকে ডাকিয়াছি। কে দেবী?”
হরবল্লভ বড় প্রমাদে পড়িলেন। ঊর্ধ্ব চতুর্দশ পুরুষের ভিতর কখনও দেবীকে দেখেন নাই। কি করেন, ভাবিয়া চিন্তিয়া নিশিকে দেখাইয়া দিলেন। নিশি খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। অপ্রতিভ হইয়া, ‘ভুল হইয়াছে’ বলিয়া হরবল্লভ দিবাকে দেখাইলেন। দিবা লহর তুলিয়া হাসিল। বিষণ্ণ মনে হরবল্লভ আবার নিশিকে দেখাইল। সাহেব তখন গরম হইয়া উঠিয়া হরবল্লভকে বলিলেন, “টোম বডজাাট–শূয়র! তোম্ পছানটেে নেহি?”

তখন দিবা বলিল, “সাহেব, রাগ করিবেন না। উনি চেনেন না। উঁহার ছেলে চেনে। উঁহার ছেলে বজরার ছাদে বসিয়া আছে, তাহাকে আনুন–সে চিনিবে।”

হরবল্লভ আকাশ হইতে পড়িল, বলিল, “আমার ছেলে!”

দি। এইরূপ শুনি।

হ। ব্রজেশ্বর।

দি। তিনিই।

হ। কোথা?

দি। ছাদে।

হ। ব্রজ এখানে কেন?

দি। তিনি বলিবেন।

সাহেব হুকুম দিলেন, “তাঁহাকে আন।”

দিবা রঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করিল। তখন রঙ্গরাজ ছাদে গিয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “চল, দিবা ঠাকুরাণীর হুকুম।”

ব্রজেশ্বর নামিয়া কামরার ভিতর আসিল। দেবীর হুকুম আগেই প্রচার হইয়াছিল, দিবার হুকুম পাইলেই ব্রজেশ্বর ছাদ হইতে নামিবে। এমনই দেবীর বন্দোবস্ত।

সাহেব ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি দেবী চৌধুরাণীকে চেন?”

ব্র। চিনি।

সা। এখানে দেবী আছে?

ব্র। না।

সাহেব তখন রাগান্ধ হইয়া বলিলেন, “সে কি, ইহারা দুই জনের একজনও দেবী চৌধুরাণী নয়?”

ব্র। এরা তার দাসী।

সা। এঃ! তুমি দেবীকে চেন?

ব্র। বিলক্ষণ চিনি।

সা। যদি এরা কেহ দেবী না হয়, তবে দেবী অবশ্য এ বজরার কোথাও লুকাইয়া আছে। বোধ হয়, দেবী সেই চাকরাণীটা। আমি বজরা তল্লাশি করিতেছি–তুমি নিশানদিহি করিবে, আইস।

ব্র। সাহেব, তোমার বজরা তল্লাশ করিতে হয়, কর–আমি নিশানদিহি করিব কেন?

সাহেব বিস্মিত হইয়া গর্জিয়া বলিল, “কেঁও বদজাত? তোম গোইন্দা নেহি?”

“নেহি।” বলিয়া ব্রজেশ্বর সাহেবের গালে বিরাশী সিক্কার এক চপেটাঘাত করিল।

“করিলে কি? করিলে কি? সর্বনাশ করিলে?” বলিয়া, হরবল্লভ কাঁদিয়া উঠিল।

“হুজুর! তুফান উঠা।” বলিয়া বাহির হইতে জমাদ্দার হাঁকিল।

সোঁ সোঁ করিয়া আকাশপ্রান্ত হইতে ভয়ঙ্কর বেগে বায়ু গর্জন করিয়া আসিতেছে শুনা গেল।
কামরার ভিতর হইতে ঠিক সেই মুহূর্তে–যে মুহূর্তে সাহেবের গালে ব্রজেশ্বরের চড় পড়িল–ঠিক সেই মুহূর্তে আবার শাঁক বাজিল। এবার দুই ফুঁ

বজরার নোঙ্গর ফেলা ছিল না–পূর্বেই বলিয়াছি, খোঁটায় কাছি বাঁধা ছিল, খোঁটার কাছে দুই জন নাবিক বসিয়াছিল। যেমন শাঁক বাজিল, অমনি তাহারা কাছি ছাড়িয়া দিয়া লাফাইয়া বজরায় উঠিল। তীরের উপরে যে সিপাহীরা বজরা ঘেরাও করিয়াছিল, তাহারা উহাদিগরে মারিবার জন্য সঙ্গীন উঠাইল–কিন্তু তাহাদের হাতের বন্দুক হাতেই রইল, পলক ফেলিতে না ফেলিতে একটা প্রকাণ্ড কাণ্ড হইয়া গেল। দেবীর কৌশলের এক পলক মধ্যে সেই পাঁচ শত কোম্পানির সিপাহী পরাস্ত হইল।

পূর্বেই বলিয়াছি যে, প্রথমাবধিই বজরার চারিখানা পাল খাটান ছিল। বলিয়াছি যে, মধ্যে নিশি ও দিবা আসিয়া, নাবিকদিগকে কি উপদেশ দিয়া গিয়াছিল। সেই উপদেশ অনুসারেই খোঁটার কাছে লোক বসিয়াছিল। আর সেই উপদেশ অনুসারে পালের কাছির কাছে চারি জন নাবিক বসিয়াছিল। শাঁকের শব্দ শুনিবা মাত্র তাহারা পালের কাছি সকল টানিয়া ধরিল। মাঝি হাল আঁটিয়া ধরিল। অমনি সেই প্রচণ্ড বেগশালী ঝটিকা আসিয়া চারিখানা পালে লাগিল। বজরা ঘুরিল–যে দুই জন সিপাহী সঙ্গীন তুলিয়াছিল, তাহাদের সঙ্গীন উঁচু হইয়া রহিল–বজরার মুখ পঞ্চাশ হাত তফাতে গেল। বজরা ঘুরিল–তার পর ঝড়ের বেগে পালভরা বজরা কাত হইল, প্রায় ডুবে। লিখিতে এতক্ষণ লাগিল–কিন্তু এতখানা ঘটিল এক নিমেষ মধ্যে। সাহেব ব্রজেশ্বরের চড়ের প্রত্যুত্তরে ঘুঁষি উঠাইয়াছেন মাত্র, ইহারই মধ্যে এতখানা সব হইয়া গেল। তাঁহারও হাতের ঘুষি হাতে রহিল, যেমন বজরা কাত হইল, অমনি সাহেব টলিয়া মুষ্টিবদ্ধহস্তে দিবা সুন্দরীর পাদমূলে পতিত হইলেন। ব্রজেশ্বর খোদ সাহেবের ঘাড়ের উপর পড়িয়া গেল–এবং রঙ্গরাজ তাহার উপর পড়িয়া গেল। হরবল্লভ প্রথমে নিশিঠাকুরাণীর ঘাড়ের উপর পড়িয়াছিলেন, পরে সেখান হইতে পদচ্যুত হইয়া গড়াইতে গড়াইতে রঙ্গরাজের নাগরা জুতায় আটকাইয়া গেলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন যে, “নৌকাখানা ডুবিয়া গিয়াছে, আমরা সকলে মরিয়া গিয়াছি, এখন আর দুর্গানাম জপিয়া কি হইবে!”

কিন্তু নৌকা ডুবিল না–কাত হইয়া আবার সোজা হইয়া বাতাসে পিছন করিয়া বিদ্যুদ্বেগে ছুটিল। যাহারা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার খাড়া হইয়া দাঁড়াইল–সাহেব আবার ঘুঁষি তুলিলেন। কিন্তু সাহেবের ফৌজ, যাহারা জলে দাঁড়াইয়াছিল, বজরা তাহাদের ঘাড়ের উপর দিয়া চলিয়া গেল। অনেকে জলে ডুবিয়া প্রাণরক্ষা করিল; কেহ দূর হইতে বজরা ঘুরিতেছে দেখিতে পাইয়া পলাইয়া বাঁচিল; কেহ বা আহত হইল; কেহ মরিল না। ছিপগুলি বজরার নীচে পড়িয়া ডুবিয়া গেল–জল সেখানে এমন বেশী নহে–স্রোত বড় নাই–সুতরাং সকলেই বাঁচিল। কিন্তু বজরা আর কেহ দেখিতে পাইল না। নক্ষত্রবেগে উড়িয়া বজরা কোথায় ঝড়ের সঙ্গে মিশিয়া চলিল, কেহ আর দেখিতে পাইল না। সিপাহী সেনা ছিন্নভিন্ন হইল। দেবী তাহাদের পরাস্ত করিয়া পাল উড়াইয়া চলিল, লেফটেনান্ট সাহেব ও হরবল্লভ দেবীর নিকট বন্দী হইল। নিমেষমধ্যে যুদ্ধ জয় হইল। দেবী তাই আকাশ দেখাইয়া বলিয়াছিল, “আমার রক্ষার উপায় ভগবান করিতেছেন।”

অষ্টম পরিচ্ছেদ
বজরা জলের রাশি ভাঙ্গিয়া, দুলিতে দুলিতে নক্ষত্র-বেগে ছুটিল। শব্দ ভয়ানক। বজরার মুখে কৃষ্ণ তরঙ্গরাশির গর্জন ভয়ানক–ঝড়ের শব্দ ভয়ানক। কিন্তু নৌকার গঠন অনুপম, নাবিকদিগের দক্ষতা ও শিক্ষা প্রসিদ্ধ। নৌকা এই ঝড়ের মুখে চারিখানা পাল দিয়া নির্বিঘ্নে চলিল। আরোহিবর্গ যাঁহারা প্রথমে কুষ্মাণ্ডাকারে গড়াগড়ি দিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলে স্বপদস্থ হইলেন। হরবল্লভ রায় মহাশয়, অঙ্গুষ্ঠে যজ্ঞোপবীত জড়িত করিয়া দুর্গানাম জপিতে আরম্ভ করিলেন, আবার না ডুবি। লেফটেনান্ট সাহেব সেই মুলতবী ঘুঁষিটা আবার পুনর্জীবিত করিবার চেষ্টায় হস্তোত্তোলন করিলেন, অমনি ব্রজেশ্বর তাঁর হাতখানা ধরিয়া ফেলিল। হরবল্লভ ছেলেকে ভর্ৎসনা করিলেন। বলিলেন, “ও কি কর, ইংরেজের গায়ে হাত তোল?”

ব্রজেশ্বর বলিল, “আমি ইংরেজের গায়ে হাত তুলেছি, না ইংরেজ আমার গায়ে হাত তুলিতেছে?”

হরবল্লভ সাহেবকে বলিলেন, “হুজুর! ও ছেলেমানুষ, আজও বুদ্ধিশুদ্ধি হয় নি, আপনি ওর অপরাধ লইবেন না। মাফ করুন।”

সাহেব বলিলেন, “ও বড় বদমাস। তবে যদি আমার কাছে ও জোড়হাত করিয়া মাফ চায়, তবে আমি মাফ করিতে পারি।”

হ। ব্রজ তাই কর। জোড়হাত করিয়া সাহেবকে বল, “আমাকে মাফ করুন।”

ব্র। সাহেব, আমরা হিন্দু, পিতার আজ্ঞা আমরা কখনও লঙ্ঘন করি না। আমি আপনার কাছে জোড়হাত করিয়া ভিক্ষা করিতেছি, আমাকে মাফ করুন।

সাহেব ব্রজেশ্বরের পিতৃভক্তি দেখিয়া প্রসন্ন হইয়া ব্রজেশ্বরকে ক্ষমা করিলেন, আর ব্রজেশ্বরের হাত লইয়া আচ্ছা করিয়া নাড়া দিলেন। ব্রজেশ্বরের চতুর্দশ পুরুষের মধ্যে কখন জানে না, সেকহ্যাকণ্ড কাকে বলে–সুতরাং ব্রজেশ্বর একটু ভেকা হইয়া রহিল। মনে করিল, “কি জানি, যদি আবার বাঁধে।” এই ভাবিয়া ব্রজেশ্বর বাহিরে গিয়া বসিল। কেবল ঝড়, –বৃষ্টি নাই, –ভিজিতে হইল না।

রঙ্গরাজ বাহিরে আসিয়া, কামরার দ্বার বন্ধ করিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া বসিল–দুই দিকের পাহারায় বিশেষ, এ সময়ে বাহিরে একটু সতর্ক থাকা ভাল, বজরা বড় তীব্রবেগে যাইতেছে, হঠাৎ বিপদ ঘটাও বিচিত্র নহে।

দিবা উঠিয়া দেবীর কাছে গেল–পুরুষ-মহলে এখন আর প্রয়োজন নাই। নিশি উঠিল না–তার কিছু মতলব ছিল। সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত–সুতরাং অগাধ সাহস।

সাহেব জাঁকিয়া আবার রূপার চৌকিতে বসিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, “ডাকাইতের হাত হইতে কিরূপে মুক্ত হইব? যাহাকে ধরিতে আসিয়াছিলাম, তাহারই কাছে ধরা পড়িলাম–স্ত্রীলোকের কাছে পরাজিত হইলাম, ইংরেজ মহলে আর কি বলিয়া মুখ দেখাইব? আমার না ফিরিয়া যাওয়াই ভাল।”

হরবল্লভ আর বসিবার স্থান না পাইয়া নিশি সুন্দরীর মসনদের কাছে বসিলেন। দেখিয়া নিশি বলিল, “আপনি একটু নিদ্রা যাবেন?”

হ। আজ কি আর নিদ্রা হয়?

নি। আজ না হইল ত আর হইল না।

হ। সে কি?

নি। আবার ঘুমাইবার দিন কবে পাইবেন?

হ। কেন?

নি। আপনি দেবী চৌধুরাণীকে ধরাইয়া দিতে আসিয়াছিলেন?

হ। তা–তা–কি জান–

নি। ধরা পড়িলে দেবীর কি হইত, জান?
হ। আ–এমন কি–

নি। এমন কিছু নয়, ফাঁসি!

হ। তা–না–এই–তা কি জান–

নি। দেবী তোমার কোন অনিষ্ট করে নাই, বরং ভারী উপকার করিয়াছিল–যখন তোমার জাতি যায়, প্রাণ যায়, তখন তোমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিয়া, তোমায় রক্ষা করিয়াছিল। তার প্রত্যুপকারে তুমি তাহাকে ফাঁসি দিবার চেষ্টায় ছিলে। তোমার যোগ্য কি দণ্ড বল দেখি?

হরবল্লভ চুপ করিয়া রহিল।

নিশি বলিতে লাগিল, “তাই বলিতেছিলাম, এই বেলা ঘুমাইয়া লও–আর রাত্রের মুখ দেখিবে না। নৌকা কোথায় যাইতেছে বল দেখি?”

হরবল্লভের কথা কহিবার শক্তি নাই।

নিশি বলিতে লাগিল, “ডাকিনীর শ্মশান বলিয়া প্রকাণ্ড শ্মশান আছে। আমরা যাদের প্রাণে মারি, তাদের সেইখানে লইয়া গিয়া মারি। বজরা এখন সেইখানে যাইতেছে। সেইখানে পৌঁছিলে সাহেব ফাঁসি যাইবে, রাণীজির হুকুম হইয়া গিয়াছে। আর তোমায় কি হুকুম করিয়াছে, জান?”

হরবল্লভ কাঁদিতে লাগিল–জোড়হাত করিয়া বলিল, “আমায় রক্ষা কর।”

নিশি বলিল, “তোমায় রক্ষা করিবে, এমন পাষণ্ড পামর কে আছে? তোমায় শূলে দিবার হুকুম হইয়াছে।”

হরবল্লভ ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। ঝড়ের শব্দ বড় প্রবল; সে কান্নার শব্দ ব্রজেশ্বর শুনিতে পাইল না–দেবীও না। সাহেব শুনিল। সাহেব কথাগুলা শুনিতে পায় নাই–কান্না শুনিতে পাইল। সাহেব ধমকাইল, “রোও মৎ-উল্লুক মর্নাি এক রোজ আল্‌বৎ হ্যায়।”

সে কথা কাণে না তুলিয়া নিশির কাছে জোড়হাত করিয়া বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাঁদিতে লাগিল। বলিল, হাঁ গা! আমায় কি কেউ রক্ষা করিতে পারে না গা?”

নি। তোমার মত নরাধমকে বাঁচাইয়া পাতকগ্রস্ত হইবে? আমাদের রাণী দয়ময়ী, কিন্তু তোমার জন্য কেহই তাঁর কাছে দয়ার ভিক্ষা করিব না।

হ। আমি লক্ষ টাকা দিব।

নি। মুখে আনিতে লজ্জা করে না? পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য এই কৃতঘ্নের কাজ করিয়াছ–আবার লক্ষ টাকা হাঁক?

হ। আমাকে যা বলিবে, তাই করিব।

নি। তোমার মত লোকের দ্বারা কোন্ কাজ হয় যে, তুমি, যা বলিব, তাই করিবে?

হ। অতি ক্ষুদ্রের দ্বারাও উপকার হয়–ওগো, কি করিতে হইবে বল, আমি প্রাণপণ করিয়া করিব–আমায় বাঁচাও।

নি। (ভাবিতে ভাবিতে) তোমার দ্বারাও আমার একটা উপকার হইলে হইতে পারে–তা তোমার মত লোকের দ্বারা সে উপকার না হওয়াই ভাল।

হ। তোমার কাছে জোড়হাত করিতেছি–তোমার হাত ধরিতেছি–

হরবল্লভ বিহ্বল–নিশি ঠাকুরাণীর বাঁউড়ী-পরা গোলগাল হাতখানি প্রায় ধরিয়া ফেলিয়াছিল আর কি! চতুরা নিশি আগে হাত সরাইয়া লইল–বলিল, “সাবধান! ও হাত শ্রীকৃষ্ণের গৃহীত। কিন্তু তোমার হাতে-পায়ে ধরিয়া কাজ নাই–তুমি যদি এতই কাতর হইয়াছ, তবে তুমি যাতে রক্ষা পাও, আমি তা করিতে রাজি হইতেছি। কিন্তু তোমায় যা বলিব, তা যে তুমি করিবে, এ বিশ্বাস হয় না। তুমি জুয়োচোর, কৃতঘ্ন, পামর, গোইন্দাগিরি কর–তোমার কথায় বিশ্বাস কি?”

হ। যে দিব্য বল, সেই দিব্য করিতেছি।
নি। তোমার আবার দিব্য? কি দিব্য করিবে?

হ। গঙ্গাজল তামা তুলসী দাও–আমি স্পর্শ করিয়া দিব্য করিতেছি। নি। ব্রজেশ্বরের মাথায় হাত দিয়া দিব্য করিতে পার?

হরবল্লভ গর্জিয়া উঠিল। বলিল, “তোমাদের যা ইচ্ছা, তাহা কর। আমি তা পারিব না।” কিন্তু এ তেজ ক্ষণিকমাত্র। হরবল্লভ আবার তখনই হাত কচলা্ইতে লাগিল–বলিল, “আর যে দিব্য বল, সেই দিব্য করিব, রক্ষা কর।”

নি। আচ্ছা, দিব্য করিতে হইবে না–তুমি আমাদের হাতে আছ। শোন, আমি বড় কুলীনের মেয়ে। আমাদের ঘরে পাত্র জোটা ভার। আমার একটি পাত্র জুটিয়াছিল, (পাঠক জানেন, সব মিথ্যা) কিন্তু আমার ছোট বহিনের জুটিল না। আজিও তাহার বিবাহ হয় নাই।

হ। বয়স কত হইয়াছে?

নি। পঁচিশ ত্রিশ।

হ। কুলীনের মেয়ে অমন অনেক থাকে।

নি। থাকে, কিন্তু আর তার বিবাহ না হইলে অঘরে পড়িবে, এমন গতিক হইয়াছে। তুমি আমার বাপের পালটি ঘর। তুমি যদি আমার ভগিনীকে বিবাহ কর, আমার বাপের কুল থাকে। আমিও এই কথা বলিয়া রাণীজির কাছে তোমার প্রাণ ভিক্ষা করিয়া লই।

হরবল্লভের মাথার উপর হইতে পাহাড় নামিয়া গেল। আর একটা বিবাহ বৈ ত নয়–সেটা কুলীনের পক্ষে শক্ত কাজ নয়–তা যত বড় মেয়ে হৌক না কেন! নিশি যে উত্তরের প্রত্যাশা করিয়াছিল, হরবল্লভ ঠিক সেই উত্তর দিল, বলিল, “এ আর বড় কথা কি? কুলীনের কুল রাখা কুলীনেরই কাজ। তবে একটা কথা এই, আমি বুড়া হইয়াছি, আমার আর বিবাহের বয়স নাই। আমার ছেলে বিবাহ করিলে হয় না?”

নি। তিনি রাজি হবেন?

হ। আমি বলিলেই হইবে।

নি। তবে আপনি কাল প্রাতে সেই আজ্ঞা দিয়া যাইবেন। তাহা হইলে, আমি পাল্কী বেহারা আনিয়া আপনাকে বাড়ী পাঠাইয়া দিব।

হরবল্লভ হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল–কোথায় শূলে যায়–কোথায় বৌভাতের ঘটা। হরবল্লভের আর দেরি সয় না। বলিল, “তবে তুমি গিয়া রাণীজিকে এ সকল কথা জানাও।”

নিশি বলিল, “চলিলাম।” নিশি দ্বিতীয় কামরার ভিতর প্রবেশ করিল।

নিশি গেলে, সাহেব হরবল্লভকে জিজ্ঞাসা করিল, “স্ত্রীলোকটা তোমাকে কি বলিতেছিল?”

হ। এমন কিছুই না।

সা। কাঁদিতেছিলে কেন?

হ। কই? কাঁদি নাই।

সা। বাঙ্গালি এমনই মিথ্যাবাদী বটে।

নি। ভিতরে আসিলে দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “আমার শ্বশুরের সঙ্গে এত কি কথা কহিতেছিলে?”

নি। দেখিলাম, যদি তোমার শাশুড়ীগিরিতে বাহাল হইতে পারি।

দেবী। নিশি ঠাকুরাণি! তোমার মন প্রাণ, জীবন যৌবন সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ করিয়াছ–কেবল জুয়াচুরিটুকু নয়। সেটুকু নিজের ব্যবহারের জন্য রাখিয়াছ।

নি। দেবতাকে ভাল সামগ্রীই দিতে হয়। মন্দ সামগ্রী কি দিতে আছে?

দেবী। তুমি নরকে পচিয়া মরিবে।

নবম পরিচ্ছেদ
ঝড় থামিল; নৌকাও থামিল। দেবী বজরার জানালা হইতে দেখিতে পাইলেন, প্রভাত হইতেছে। বলিলেন, “নিশি! আজ সুপ্রভাত!”

নিশি বলিল, “আমি আজ সুপ্রভাত!”

দি। তুমি অবসান, আমি সুপ্রভাত!

নি। যেদিন আমার অবসান হইবে, সেই দিনই আমি সুপ্রভাত বলিব। এ অন্ধকারের অবসান নাই। আজ বুঝিলাম, দেবী চৌধুরাণীর সুপ্রভাত–কেন না, আজ দেবী চৌধুরাণীর অবসান।

দি। ও কি কথা লো পোড়ারমুখী?

নি। কথা ভাল। দেবী মরিয়াছে। প্রফুল্ল শ্বশুরবাড়ী চলিল।

দেবী। তার এখন দেরী ঢের। যা বলি, কর দেখি। বজরা বাঁধিতে বল দেখি।

নিশি হুকুম জারি করিল–মাঝিরা তীরে লাগাইয়া বজরা বাঁধিল। তার পর দেবী বলিল, “রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা কর, কোথায় আসিয়াছি? রঙ্গপুর কত দূর? ভূতনাথ কত দূর?”

রঙ্গরাজ জিজ্ঞাসায় বলিল, “এক রাত্রে চারি দিনের পথ আসিয়াছি। রঙ্গপুর এখান হইতে অনেক দিনের পথ। ডাঙ্গা-পথে ভূতনাথে এক দিনে যাওয়া যাইতে পারে।”

“পাল্কী বেহারা পাওয়া যাইবে?”

“আমি চেষ্টা করিলে সব পাওয়া যাইবে।”

দেবী নিশিকে বলিল, “তবে আমার শ্বশুরকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দাও।”

দি। এত তাড়াতাড়ি কেন?

নি। শ্বশুরের ছেলে সমস্ত রাত্রি বাহিরে বসিয়া আছে, মনে নাই? বাছাধন সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া লঙ্কায় আসিতে পারিতেছে না, দেখিতেছ না?

এই বলিয়া নিশি রঙ্গরাজকে ডাকিয়া, হরবল্লভের সাক্ষাতে বলিল, “সাহেবটাকে ফাঁসি দিতে হইবে। ব্রাহ্মণটাকে এখন শূলে দিয়া কাজ নাই। উহাকে পাহারাবন্দী করিয়া স্নানাহ্নিকে পাঠাইয়া দাও।”

হরবল্লভ বলিলেন, “আমার উপর হুকুম কিছু হইয়াছে?”

নিশি চোখ টিপিয়া বলিল, “আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হইয়াছে। তুমি স্নানাহ্নিক করিয়া আইস।”

নিশি রঙ্গরাজের কাণে কাণে বলিল, “পাহারা মানে জল-আচরণী ভৃত্য।”

রঙ্গরাজ সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া হরবল্লভকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দিল।

তখন দেবী নিশিকে বলিল, “সাহেবটাকে ছাড়িয়া দিতে বল। সাহেবকে রঙ্গপুর ফিরিয়া যাইতে বল। রঙ্গপুর অনেক দূর, এক শত মোহর উহাকে পথখরচ দাও, নহিলে এত পথ যাইবে কি প্রকারে?”
নিশি শত স্বর্গ লইয়া গিয়া রঙ্গরাজকে দিল, আর কাণে কাণে উপদেশ দিল। উপদেশে দেবী যাহা বলিয়াছিল, তাহা ছাড়া আরও কিছু ছিল।

রঙ্গরাজ তখন দুই জন বরকন্দাজ লইয়া আসিয়া সাহেবকে ধরিল। বলিল, “উঠ।”

সা। কোথা যাইতে হইবে?

র। তুমি কয়েদী–জিজ্ঞাসা করিবার কে?

সাহেব বাক্যব্যয় না করিয়া রঙ্গরাজের পিছু পিছু দুই জন বরকন্দাজের মাঝে চলিল। যে ঘাটে হরবল্লভ স্নান করিতেছিলেন, সেই ঘাট দিয়া তাহারা যায়।

হরবল্লভ জিজ্ঞাসা করিল, “সাহেবকে কোথায় লইয়া যাইতেছ?”

রঙ্গরাজ বলিল, “এই জঙ্গলে।”

হ। কেন?

র। জঙ্গলের ভিতর গিয়া ফাঁসি দিব।

হরবল্লভের গা কাঁপিল। সে সন্ধ্যা-আহ্নিকের সব মন্ত্র ভুলিয়া গেল। সন্ধ্যাহ্নিক ভাল হইল না।

রঙ্গরাজ জঙ্গলে সাহেবকে লইয়া গিয়া বলিল, “আমরা কাহাকে ফাঁসি দিই না। তুমি ঘরের ছেলে ঘরে যাও, আমাদের পিছনে আর লেগো না। তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম।”

সাহেব প্রথমে বিস্ময়াপন্ন হইল–তার পর ভাবিল, “ইংরেজকে ফাঁসি দেয়, বাঙ্গালির এত কি ভরসা?”

তার পর রঙ্গরাজ বলিল, “সাহেব! রঙ্গপুর অনেক পথ, যাবে কি প্রকারে?”

সা। যে প্রকারে পারি।

র। নৌকা ভাড়া কর, গ্রামে গিয়া ঘোড়া কেন–নয় পাল্কী কর। তোমাকে আমাদের রাণী এত শত মোহর পথখরচ দিয়াছেন।

রঙ্গরাজ মোহর গণিয়া দিতে লাগিল। সাহেব পাঁচ থান মোহর লইয়া আর লইল না। বলিল, “ইহাতেই যথেষ্ট হইবে। এ আমি কর্জ লইলাম।”

র। আচ্ছা, আমরা যদি তোমার কাছে আদায় করতে যাই ত শোধ দিও। আর তোমার সিপাহী যদি কেহ জখম হইয়া থাকে, তাহাকে পাঠাইয়া দিও। যদি কেহ মরিয়া থাকে, তবে তাদের ওয়ারেশকে পাঠাইয়া দিও।

সা। কেন?

র। এমন অবস্থায় রাণী কিছু কিছু দান করিয়া থাকেন।

সাহেব বিশ্বাস করিল না। ভাল মন্দ কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল।

রঙ্গরাজ তখন পাল্কী বেহারার সন্ধানে গেল। তার প্রতি সে আদেশও ছিল।

দশম পরিচ্ছেদ
এদিকে পথ সাফ দেখিয়া, ব্রজেশ্বর ধীরে ধীরে দেবীর কাছে আসিয়া বসিলেন।

দেবী বলিল, “ভাল হইল, দেখা দিলে। তোমার কথা ভিন্ন আজিকার কাজ নয়। তুমি প্রাণ রাখিতে হুকুম দিয়াছিলে, তাই প্রাণ রাখিয়াছি। দেবী মরিয়াছে, দেবী চৌধুরাণী আর নাই। কিন্তু প্রফুল্ল এখনও আছে। প্রফুল্ল থাকিবে, না দেবীর সঙ্গে যাইবে?”

ব্রজেশ্বর আদর করিয়া প্রফুল্লের মুখচুম্বন করিল। বলিল, “তুমি আমার ঘরে চল, ঘর আলো হইবে। তুমি না যাও–আমি যাইব না।”

প্র। আমি ঘরে গেলে আমার শ্বশুর কি বলিবেন?

ব্র। সে ভার আমার। তুমি উদ্যোগ করিয়া তাঁকে আগে পাঠাইয়া দাও। আমরা পশ্চাৎ যাইব।

প্র। পাল্কী বেহারা আনিতে গিয়াছে।

পাল্কী বেহারা শীঘ্রই আসিল। হরবল্লভও সন্ধ্যাহ্নিক সংক্ষেপে সারিয়া বজরায় আসিয়া উঠিলেন। দেখিলেন, নিশি ঠাকুরাণী ক্ষীর, ছানা, মাখন ও উত্তম সুপক্ক আম্র, কদলী প্রভৃতি ফল তাঁহার জলযোগের জন্য সাজাইতেছে। নিশি অনুনয় বিনয় করিয়া, তাঁহাকে জলযোগে বসাইল। বলিল, “এখন আপনি আমার কুটুম্ব হইলেন; জলযোগ না করিয়া যাইতে পারিবেন না।”

হরবল্লভ জলযোগে না বসিয়া বলিল, “ব্রজেশ্বর কোথায়? কাল রাত্রে বাহিরে উঠিয়া গেল–আর তাকে দেখি নাই।”

নিশি। তিনি আমার ভগিনীপতি হইবেন–তাঁর জন্য ভাবিবেন না। তিনি এইখানেই আছেন–আপনি জলযোগে বসুন; আমি তাঁহাকে ডাকিয়া দিতেছি। সেই কথাটা তাঁকে বলিয়া যাউন।

হরবল্লভ জলযোগে বসিল। নিশি ব্রজেশ্বরকে ডাকিয়া আনিল। ভিতরের কামরা হইতে ব্রজেশ্বর বাহির হইল দেখিয়া উভয়ে কিছু অপ্রতিভ হইলেন। হরবল্লভ ভাবিলেন, আমার চাঁদপানা ছেলে দেখে, ডাকিনী বেটীরা ভুলে গিয়েছে। ভালই।

ব্রজেশ্বরকে হরবল্লভ বলিলেন, “বাপু হে, তুমি যে এখানে কি প্রকারে আসিলে, আমি ত তা এখনও কিছু বুঝিতে পারি নাই। তা যাক–সে এখনকার কথা নয়, সে কথা পরে হবে। এক্ষণে আমি একটু অনুরোধে পড়েছি–তা অনুরোধটা রাখিতে হইবে। এই ঠাকুরাণীটি সৎকুলীনের মেয়ে–ওঁর বাপ আমাদেরই পালটি–তা ওঁর একটি অবিবাহিতা ভগিনী আছে–পাত্র পাওয়া যায় না–কুল যায়। তা কুলীনের কুলরক্ষা কুলীনেরই কাজ–মুটে মজুরের ত কাজ নয়। আর তুমিও পুনর্বার সংসার কর, সেটাও আমার ইচ্ছা বটে, তোমার গর্ভধারিণীরও ইচ্ছা বটে। বিশেষ বড় বউমাটির পরলোকের পর থেকে আমরা কিছু এ বিষয়ে কাতর আছি। তাই বলছিলাম, যখন অনুরোধে পড়া গেছে, তখন এ কর্তব্যই হয়েছে। আমি অনুমতি করিতেছি, তুমি এঁর ভগিনীকে বিবাহ কর।”

ব্রজেশ্বর মোটের উপর বলিল, “যে আজ্ঞা।”

নিশির বড় হাসি পাইল, কিন্তু হাসিল না। হরবল্লভ বলিতে লাগিলেন, “তা আমার পাল্কী বেহারা এসেছে, আমি আগে গিয়া বৌভাতের উদ্যোগ করি। তুমি যথাশাস্ত্র বিবাহ করে বৌ নিয়ে বাড়ী যেও।”

ব্র। যে আজ্ঞা।
হ। তা তোমায় আর বলিব কি, তুমি ছেলেমানুষ নও–কুল, শীল, জাতি, মর্যাদা, সব আপনি দেখে শুনে বিবাহ করবে। (পরে একটু আওয়াজ খাটো করিয়া বলিতে লাগিলেন) আর আমাদের যেটা ন্যায্য পাওনা গণ্ডা, তাও ত জান?

ব্র। যে আজ্ঞা।

হরবল্লভ জলযোগ সমাপন করিয়া বিদায় হইলেন। ব্রজ ও নিশি তাঁহার পদধূলি লইল। তিনি পাল্কীতে চড়িয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া দুর্গানাম করিয়া প্রাণ পাইলেন। ভাবিলেন, “ছেলেটি ডাকিনী বেটীদের হাতে রহিল–তা ভয় নাই। ছেলে আপনার পথ চিনিয়াছে। চাঁদমুখের সর্বত্র জয়।”

হরবল্লভ চলিয়া গেলে, ব্রজেশ্বর নিশিকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ আবার কি ছল? তোমার ছোট বোন্ কে?”

নি। চেন না? তার নাম প্রফুল্ল।

ব্র। ওহো! বুঝিয়াছি। কি রকমে এ সম্বন্ধে কর্তাকে রাজি করিলে?

নি। মেয়েমানুষের অনেক রকম আছে। ছোট বোনের শাশুড়ী হইতে নাই, নহিলে আরও একটা সম্বন্ধে তাঁকে রাজি করিতে পারিতাম।

দিবা রাগিয়া উঠিয়া বলিল, “তুমি শীগ্‌গির মর। লজ্জা সরম কিছু নাই? পুরুষমানুষের সঙ্গে কি অমন করে কথা কহিতে হয়?”

নি। কে আবার পুরুষমানুষ? ব্রজেশ্বর? কাল দেখা গিয়াছে–কে পুরুষ, কে মেয়ে।

ব্র। আজিও দেখিবে। তুমি মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের মত মোটা বুদ্ধির কাজ করিয়াছ। কাজটা ভাল হয় নাই।

নি। সে আবার কি?

ব্র। বাপের সঙ্গে কি প্রবঞ্চনা চলে? বাপের চোখে ধূলা দিয়া, মিছে কথা বহাল রাখিয়া আমি স্ত্রী লইয়া সংসার করিব। যদি বাপকে ঠকাইলাম, তবে পৃথিবীতে কার কাছে জুয়াচুরি করিতে আমাকে আটকাইবে?

নিশি অপ্রতিভ হইল, মনে মনে স্বীকার করিল, ব্রজেশ্বর পুরুষ বটে। কেবল লাঠিবাজিতে পুরুষ হয় না, নিশি তা বুঝিল। বলিল, “এখন উপায়?”

ব্র। উপায় আছে। চল, প্রফুল্লকে লইয়া ঘরে যাই। সেখানে গিয়া বাপকে সকল কথা ভাঙ্গিয়া বলিব। লুকোচুরি হইবে না।

নি। তা হইলে তোমার বাপ কি দেবী চৌধুরাণীকে বাড়ীতে উঠিতে দিবেন?

দেবী বলিল, “দেবী চৌধুরাণী কে? দেবী চৌধুরাণী মরিয়াছে, তার নাম এ পৃথিবীতে মুখেও আনিও না। প্রফুল্লের কথা বল।”

নি। প্রফুল্লকেই কি তিনি ঘরে স্থান দিবেন?

ব্র। আমি ত বলিয়াছি যে, সে ভার আমার।

প্রফুল্ল সন্তুষ্ট হইল। বুঝিয়াছিল যে, ব্রজেশ্বরের ভার বহিবার ক্ষমতা না থাকিলে, সে ভার লইবার লোক নহে।

একাদশ পরিচ্ছেদ

তখন ভূতনাথে যাইবার উদ্যোগ আরম্ভ হইল। রঙ্গরাজকে সেইখান হইতে বিদায় দিবার কথা স্থির হইল। কেন না, ব্রজেশ্বরের দ্বারবানেরা একদিন তাহার লাঠি খাইয়াছিল, যদি দেখিতে পায়, তবে চিনিবে। রঙ্গরাজকে ডাকিয়া সকল কথা বুঝাইয়া দেওয়া হইল, কতক নিশি বুঝাইল, কতক প্রফুল্ল নিজে বুঝাইল। রঙ্গরাজ কাঁদিল; –বলিল, “মা, আমাদিগকে ত্যাগ করিবেন, তা ত কখনও জানিতাম না।” সকলে মিলিয়া রঙ্গরাজকে সান্ত্বনা দিল। দেবীগড়ে প্রফুল্লের ঘর বাড়ী, দেবসেবা, দেবত্র সম্পত্তি ছিল। সে সকল প্রফুল্ল রঙ্গরাজকে দিলেন, বলিলেন, “সেইখানে গিয়া বাস কর। দেবতার ভোগ হয়, প্রসাদ খাইয়া দিনপাত করিও। আর কখনও লাঠি ধরিও না। তোমরা যাকে পরোপকার বল, সে বস্তুতঃ পরপীড়ন। ঠেঙ্গা লাঠির দ্বারা পরোপকার হয় না। দুষ্টের দমন রাজা না করেন, ঈশ্বর করিবেন–তুমি আমি কে? শিষ্টের পালনের ভার লইও–কিন্তু দুষ্টের দমনের ভার ঈশ্বরের উপর রাখিও। এই সকল কথাগুলি আমার পক্ষ হইতে ভবানী ঠাকুরকেও বলিও; তাঁকে আমার কোটি কোটি প্রণাম জানাইও।”

রঙ্গরাজ কাঁদিতে কাঁদিতে বিদায় হইল। দিবা ও নিশি সঙ্গে সঙ্গে ভূতনাথের ঘাট পর্যন্ত চলিল। সেই বজরায় ফিরিয়া তাহারা দেবীগড়ে গিয়া বাস করিবে, প্রসাদ খাইবে আর হরিনাম করিবে। বজরায় দেবীর রাণীগিরির আসবাব সব ছিল, পাঠক দেখিয়াছেন। তাহার মূল্য অনেক টাকা। প্রফুল্ল সব দিবা ও নিশিকে দিলেন। বলিলেন, “এ সকল বেচিয়া যাহা হইবে, তাহার মধ্যে তোমাদের যাহা প্রয়োজন, ব্যয় করিবে। বাকী দরিদ্রকে দিবে। এ সকল আমার কিছুই নয়–আমি ইহার কিছুই লইব না।” এই বলিয়া প্রফুল্ল আপনার বহুমূল্য বস্ত্রালঙ্কারগুলি নিশি ও দিবাকে দিলেন।

নিশি বলিল, “মা! নিরাভরণে শ্বশুরবাড়ী উঠিবে?”

প্রফুল্ল ব্রজেশ্বরকে দেখাইয়া দিয়া বলিল, “স্ত্রীলোকের এই আভরণ সকলের ভাল। আর আভরণের কাজ কি, মা?”

নিশি বলিল, “আজ তুমি প্রথম শ্বশুরবাড়ী যাইতেছ; আমি আজ তোমাকে কিছু যৌতুক দিয়া আশীর্বাদ করিব। তুমি মানা করিও না, এই আমার শেষের সাধ–সাধ মিটাইতে দাও।”

এই বলিয়া নিশি কতকগুলি বহুমূল্য রত্নালঙ্কারে প্রফুল্লকে সাজাইতে লাগিল। পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, নিশি এক রাজমহিষীর কাছে থাকিত, রাজমহিষী তাহাকে অনেক অলঙ্কার দিয়াছিলেন। এ সেই গহনা। দেবী তাহাকে নূতন গহনা দিয়াছিলেন বলিয়া সেগুলি নিশি পরিত না। এক্ষণে দেবীকে নিরাভরণা দেখিয়া সেইগুলি পরাইল। তার পর আর কোন কাজ নাই, কাজেই তিন জনে কাঁদিতে বসিল। নিশি গহনা পরাইবার সময়েই সুর তুলিয়াছিল; দিবা তৎক্ষণাৎ পোঁ ধরিলেন। তার পোঁ সানাই ছাপাইয়া উঠিল। প্রফুল্লও কাঁদিল–না কাঁদিবার কথা কি? তিন জনের আন্তরিক ভালবাসা ছিল; কিন্তু প্রফুল্লের মন আহ্লাদে ভরা, কাজেই প্রফুল্ল অনেক নরম গেল। নিশিও দেখিল যে, প্রফুল্লের মন সুখে ভরা; নিশিও সে সুখে সুখী হইল, কান্নায় সেও একটু নরম গেল। সে বিষয়ে যাহার যে ত্রুটি হইল, দিবা ঠাকুরাণী তাহা সারিয়া লইলেন।

যথাকালে বজরা ভূতনাথের ঘাটে পৌঁছিল। সেইখানে দিবা ও নিশির পায়ের ধূলা লইয়া, প্রফুল্ল তাহাদিগের কাছে বিদায় লইল। তাহারা কাঁদিতে কাঁদিতে সেই বজরায় ফিরিয়া যথাকালে দেবীগড়ে পৌঁছিল। দাঁড়ী মাঝি বর্কইন্দাজের বেতন হিসাব করিয়া দিয়া, তাহাদের জবাব দিল। বজরাখানি রাখা অকর্তব্য–চেনা বজরা। প্রফুল্ল বলিয়া দিয়াছিল, “উহা রাখিও না।” নিশি বজরাখানাকে চেলা করিয়া দুই বৎসর ধরিয়া পোড়াইল।

এই চেলা কাঠের উপঢৌকন দিয়া পাঠক নিশি ঠাকুরাণীর কাছে বিদায় লউন। অনুপযুক্ত হইবে না।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ভূতনাথের ঘাটে প্রফুল্লের বজরা ভিড়িবামাত্র, কে জানে কোথা দিয়া, গ্রামময় রাষ্ট্র হইল যে, ব্রজেশ্বর আবার একটা বিয়ে করে এনেছে; বড় না কি ধেড়ে বৌ। সুতরাং ছেলে বুড়ো, কাণা খোঁড়া যে যেখানে ছিল, সব বৌ দেখিতে ছুটিল। যে রাঁধিতেছিল, সে হাঁড়ি ফেলিয়া ছুটিল; যে মাছ কুটিতেছিল, সে মাছে চুপড়ি চাপা দিয়া ছুটিল; যে স্নান করিতেছিল, সে ভিজে কাপড়ে ছুটিল। যে খাইতে বসিয়াছিল, তার আধপেটা বৈ খাওয়া হইল না। যে কোন্দল করিতেছিল, শত্রুপক্ষের সঙ্গে হঠাৎ তার মিল হইয়া গেল। যে মাগী ছেলে ঠেঙ্গাইতেছিল, তার ছেলে সে যাত্রা বাঁচিয়া গেল, মার কোলে উঠিয়া ধেড়ে বৌ দেখিতে চলিল। কাহারও স্বামী আহারে বসিয়াছেন, পাতে ডাল তরকারি পড়িয়াছে, মাছের ঝোল পড়ে নাই, এমন সময়ে বৌয়ের খবর আসিল, আর তাঁর কপালে সেদিন মাছের ঝোল হইল না। এইমাত্র বুড়ী নাতনীর সঙ্গে কাজিয়া করিতেছিল যে, “আমার হাত ধরিয়া না নিয়ে গেলে, আমি কেমন করে পুকুরঘাটে যাই?” এমন সময় গোল হইল–বৌ এসেছে, অমনি নাতনী আয়ি ফেলিয়া বৌ দেখিতে গেল, আয়িও কোন রকমে সেইখানে উপস্থিত। এক যুবতী মার কাছে তিরস্কার খাইয়া শপথ করিতেছিলেন যে, তিনি কখন বাহির হন না, এমন সময়ে বৌ আসার সংবাদ পৌঁছিল, শপথটা সম্পূর্ণ হইল না; যুবতী বৌয়ের বাড়ীর দিকে ছুটিলেন। মা শিশু ফেলিয়া ছুটিল, শিশু মার পিছু পিছু কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটিল। ভাশুর, স্বামী বসিয়া আছে, ভ্রাতৃবধূ মানিল না, ঘোমটা টানিয়া সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল। ছুটিতে যুবতীদের কাপড় খসিয়া পড়ে, আঁটিয়া পরিবার অবকাশ নাই। চুল খুলিয়া পড়ে, জড়াইবার অবকাশ নাই। সামলাইতে কোথাকার কাপড় কোথায় টানেন, তারও বড় ঠিক নাই। হুলস্থূল পড়িয়া গেল। লজ্জায় লজ্জাদেবী পলায়ন করিলেন।

বর-কন্যা আসিয়া পিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়াছে, গিন্নী বরণ করিতেছেন। বৌয়ের মুখ দেখিবার জন্য লোকে ঝুঁকিয়াছে, কিন্তু বৌ বৌগিরির চাল ছাড়ে না, দেড় হাত ঘোমটা টানিয়া রাখিয়াছে, কেহ মুখ দেখিতে পায় না। শাশুড়ী বরণ করিবার সময়ে একবার ঘোমটা খুলিয়া বধূর মুখ দেখিলেন। একটু চমকিয়া উঠিলেন, আর কিছু বলিলেন না, কেবল বলিলেন, “বেশ বউ।” তাঁর চোখে একটু জল আসিল।

বরণ হইয়া গেলে, বধূ ঘরে তুলিয়া শাশুড়ী সমবেত প্রতিবাসিনীদিগকে বলিলেন, “মা! আমার বেটা-বউ অনেক দূর থেকে আসিতেছে, ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর। আমি এখন ওদের খাওয়াই দাওয়াই। ঘরের বউ ত ঘরেই রহিল, তোমরা নিত্য দেখবে; এখন ঘরে যাও, খাও দাও গিয়া।”

গিন্নীর এই বাক্যে অপ্রসন্ন হইয়া নিন্দা করিতে করিতে প্রতিবাসিনীরা ঘরে গেল। দোষ গিন্নীর, কিন্তু নিন্দাটা বধূরই অধিক হইল; কেন না, বড় কেহ মুখ দেখিতে পায় নাই। ধেড়ে মেয়ে বলিয়া সকলেই ঘৃণা প্রকাশ করিল। আবার সকলেই বলিল, “কুলীনের ঘরে অমন ঢের হয়।” তখন যে যেখানে কুলীনের ঘরে বুড়ো বৌ দেখিয়াছে, তার গল্প করিতে লাগিল। গোবিন্দ মুখুয্যা পঞ্চান্ন বৎসরের একটা মেয়ে বিয়ে করিয়াছিল, হরি চাটু্য্যা সত্তর বৎসরের এক কুমারী ঘরে আনিয়াছিলেন, মনু বাঁড়ুয্যা একটি প্রাচীনার অন্তর্জলে তাহার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, এই সকল আখ্যায়িকা সালঙ্কারে পথিমধ্যে ব্যাখ্যাত হইতে লাগিল। এইরূপ আন্দোলন করিয়া ক্রমে গ্রাম ঠাণ্ডা হইল।

গোলমাল মিটিয়া গেল; গিন্নী বিরলে ব্রজেশ্বরকে ডাকিলেন। ব্রজ আসিয়া বলিল,“কি মা?”

গিন্নী। বাবা, এ বৌ কোথায় পেলে, বাবা?

ব্রজ। এ নূতন বিয়ে নয়, মা!
গিন্নী। বাবা, এ হারাধন আবার কোথায় পেলে, বাবা?

গিন্নীর চোখে জল পড়িতেছিল।

ব্রজ। মা, বিধাতা দয়া করিয়া আবার দিয়াছেন। এখন মা, তুমি বাবাকে কিছু বলিও না। নির্জনে পাইলে আমি সকলই তাঁর সাক্ষাতে প্রকাশ করিব।

গিন্নী। তোমাকে কিছু বলিতে হইবে না, বাপ, আমিই সব বলিব। বৌভাতটা হইয়া যাক। তুমি কিছু ভাবিও না। এখন কাহারও কাছে কিছু বলিও না।

ব্রজেশ্বর স্বীকৃত হইল। এ কঠিন কাজের ভার মা লইলেন। ব্রজ বাঁচিল। কাহাকে কিছু বলিল না।

পাকস্পর্শ নির্বিঘ্নে হইয়া গেল। বড় ঘটা পটা কিছু হইল না, কেবল জনকতক আত্মীয়স্বজন ও কুটুম্ব নিমন্ত্রণ করিয়া হরবল্লভ কার্য সমাধা করিলেন।

পাকস্পর্শের পর গিন্নী আসল কথাটা হরবল্লভকে ভাঙ্গিয়া বলিলেন। বলিলেন, “এ নূতন বিয়ে নয়–সেই বড় বউ।”

হরবল্লভ চমকিয়া উঠিল–সুপ্ত ব্যাঘ্রকে কে যেন বাণে বিঁধিল। “অ্যাঁ, সেই বড় বউ–কে বল্লে?”

গিন্নী। আমি চিনেছি। আর ব্রজও আমাকে বলিয়াছে।

হর। সে যে দশ বৎসর হল মরে গেছে।

গিন্নী। মরা মানুষেও কখন ফিরে থাকে?

হর। এত দিন সে মেয়ে কোথায় কার কাছে ছিল?

গিন্নী। তা আমি ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করি নাই। জিজ্ঞাসাও করিব না। ব্রজ যখন ঘরে আনিয়াছে, তখন না বুঝিয়া সুঝিয়া আনে নাই।

হর। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।

গিন্নী। আমার মাথা খাও, তুমি একটি কথাও কহিও না। তুমি একবার কথা কহিয়াছিলে, তার ফলে আমার ছেলে আমি হারাইতে বসিয়াছিলাম। আমার একটি ছেলে। আমার মাথা খাও, তুমি একটি কথাও কহিও না। যদি তুমি কোন কথা কহিবে, তবে আমি গলায় দড়ি দিব।

হরবল্লভ এতটুকু হইয়া গেলেন। একটি কথাও কহিলেন না। কেবল বলিলেন, “তবে লোকের কাছে নূতন বিয়ের কথাটাই প্রচার থাক।”

গিন্নী বলিলেন, “তাই থাকিবে।”

সময়ান্তরে গিন্নী ব্রজেশ্বরকে সুসংবাদ জানাইলেন। বলিলেন, “আমি তাঁকে বলিয়াছিলাম। তিনি কোন কথা কহিবেন না। সে সব কথার আর কোন উচ্চবাচ্যে কাজ নাই।”

ব্রজ হৃষ্টচিত্তে প্রফুল্লকে খবর দিল।

আমরা স্বীকার করি, গিন্নী এবার বড় গিন্নীপনা করিয়াছেন। যে সংসারের গিন্নী গিন্নীপনা জানে, সে সংসারে কারও মনঃপীড়া থাকে না। মাঝিতে হাল ধরিতে জানিলে নৌকার ভয় কি?

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
প্রফুল্ল সাগরকে দেখিতে চাহিল। ব্রজেশ্বরের ইঙ্গিত পাইয়া গিন্নী সাগরকে আনিতে পাঠাইলেন। গিন্নীরও সাধ, তিনটি বৌ একত্র করেন।

যে লোক সাগরকে আনিতে গিয়াছিল, তাহার মুখে সাগর শুনিল, স্বামী আর একটা বিবাহ করিয়া আনিয়াছেন–বুড়ো মেয়ে। সাগরের বড় ঘৃণা হইল। “ছি! বুড়ো মেয়ে!” বড় রাগ হইল, “আবার বিয়ে?–আমরা কি স্ত্রী নই?” দুঃখ হইল, “হায়! বিধাতা কেন আমায় দুঃখীর মেয়ে করেন নাই–আমি কাছে থাকিতে পারিলে, তিনি হয় ত আর বিয়ে করিতেন না।”

এইরূপ রুষ্ট ও ক্ষুণ্ণভাবে সাগর শ্বশুরবাড়ী আসিল। আসিয়াই প্রথমে নয়ান বৌয়ের কাছে গেল। নয়ান বৌ, সাগরের দুই চক্ষের বিষ; সাগর বৌ, নয়ানেরও তাই। কিন্তু আজ দুই জন এক, দুই জনের এক বিপদ্। তাই ভাবিয়া সাগর আগে নয়নতারার কাছে গেল। সাপকে হাঁড়ির ভিতর পুরিলে, সে যেমন গর্জিতে থাকে, প্রফুল্ল আসা অবধি নয়নতারা সেইরূপ করিতেছিল। একবার মাত্র ব্রজেশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল–গালির চোটে ব্রজেশ্বর পলাইল, আর আসিল না। প্রফুল্লও ভাব করিতে গিয়াছিল, কিন্তু তারও সেই দশা ঘটিল। স্বামী সপত্নী দূরে থাক, পাড়াপ্রতিবাসীও সে কয় দিন নয়নতারার কাছে ঘেঁষিতে পারে নাই। নয়নতারার কতকগুলি ছেলে-মেয়ে হইয়াছিল। তাদেরই বিপদ্ বেশী। এ কয় দিন মার খাইতে খাইতে তাদের প্রাণ বাহির হইয়া গেল।

সেই দেবীর শ্রীমন্দিরে প্রথম সাগর গিয়া দেখা দিলেন। দেখিয়া নয়নতারা বলিল, “এসো, এসো! তুমি বাকী থাক কেন? আর ভাগীদার কেউ আছে?”

সা। কি! আবার না কি বিয়ে করেছে?

ন। কে জানে, বিয়ে কি নিকে, তার খবর আমি কি জানি?

সা। বামনের মেয়ের কি আবার নিকে হয়?

ন। বামন, কি শূদ্র, কি মুসলমান, তা কি আমি দেখতে গেছি?

সা। অমন কথাগুলো মুখে এনো না। আপনার জাত বাঁচিয়ে সবাই কথা কয়।

ন। যার ঘরে অত বড় কনে বৌ এলো, তার আবার জাত কি?

সা। কত বড় মেয়ে? আমাদের বয়স হবে?

ন। তোর মার বয়সী।

সা। চুল পেকেছে?

ন। চুল না পাকলে আর রাত্রি দিন বুড়ো মাগী ঘোমটা টেনে বেড়ায়?

সা। দাঁত পড়েছে?

ন। চুল পাকলো, দাঁত আর পড়ে নি?

সা। তবে স্বামীর চেয়ে বয়সের বড় বল?

ন। তবে শুনচিস কি?

সা। তাও কি হয়?

ন। কুলীনের ঘরে এ সব হয়।

সা। দেখতে কেমন?

ন। রূপের ধ্বজা! যেন গালফুলো গোবিন্দের মা।
সা। যে বিয়ে করেছে, তাকে কিছু বল নি?

ন। দেখতে পাই কি? দেখতে পেলে হয়। মুড়ো ঝাঁটা তুলে রেখেছি।

সা। আমি তবে সে সোণার প্রতিমাখানা দেখে আসি।

ন। যা, জন্ম সার্থক করগে যা।

নূতন সপত্নীকে খুঁজিয়া, সাগর তাহাকে পুকুর-ঘাটে ধরিল। প্রফুল্ল পিছন ফিরিয়া বাসন মাজিতেছিল। সাগর পিছনে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁ গা, তুমি আমাদের নূতন বৌ?”

“কে সাগর এয়েছ?” বলিয়া নূতন বৌ সমুখ ফিরিল।

সাগর দেখিল, কে। বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “দেবী রাণী?”

প্রফুল্ল বলিল, “চুপ্! দেবী মরিয়া গিয়াছে।”

সা। প্রফুল্ল?

প্র। প্রফুল্লও মরিয়া গিয়াছে।

সা। কে তবে তুমি?

প্র। আমি নূতন বৌ।

সা। কেমন করে কি হল, আমায় সব বল দেখি।

প্র। এখানে বলিবার জায়গা নয়। আমি একটি ঘর পাইয়াছি, সেইখানে চল, সব বলিব।

দুই জনে দ্বার বন্ধ করিয়া, বিরলে বসিয়া কথোপকথন হইল। প্রফুল্ল সাগরকে সব বুঝাইয়া বলিল। শুনিয়া সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “এখন গৃহস্থালিতে কি মন টিকিবে? রূপার সিংহাসনে বসিয়া, হীরার মুকুট পরিয়া, রাণীগিরির পর কি বাসনমাজা ঘরঝাঁট দেওয়া ভাল লাগিবে? যোগশাস্ত্রের পর কি ব্রহ্মঠাকুরাণীর রূপকথা ভাল লাগিবে? যার হুকুমে দুই হাজার লোক খাটিত, এখন হারির মা, পারির মার হুকুম-বরদা রি কি তার ভাল লাগিবে?”

প্র। ভাল লাগিবে বলিয়াই আসিয়াছি। এই ধর্মই স্ত্রীলোকের ধর্ম; রাজত্ব স্ত্রীজাতির ধর্ম নয়। কঠিন ধর্মও এই সংসারধর্ম; ইহার অপেক্ষা কোন যোগই কঠিন নয়। দেখ, কতকগুলি নিরক্ষর, স্বার্থপর, অনভিজ্ঞ লোক লইয়া আমাদের নিত্য ব্যবহার করিতে হয়। ইহাদের কারও কোন কষ্ট না হয়, সকলে সুখী হয়, সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। এর চেয়ে কোন্ সন্ন্যাস কঠিন? এর চেয়ে কোন্ পুণ্য বড় পুণ্য? আমি এই সন্ন্যাস করিব।

সা। তবে কিছু দিন আমি তোমার কাছে থাকিয়া তোমার চেলা হইব।

যখন সাগরের সঙ্গে প্রফুল্লের এই কথা হইতেছিল, তখন ব্রহ্মঠাকুরাণীর কাছে ব্রজেশ্বর ভোজনে বসিয়াছিলেন। ব্রহ্মঠাকুরাণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বেজ, এখন কেমন রাধি?”

ব্রজেশ্বরের সেই দশ বছরের কথা মনে পড়িল। কথাগুলি মূল্যবান–তাই দুই জনেরই মনে ছিল।

ব্রজ। “বেশ্।”

ব্রহ্ম। এখন গোরুর দুধ কেমন? বেগড়ায় কি?

ব্রজ। বেশ্ দুধ।

ব্রহ্ম। কই, দশ বৎসর হলো–আমায় ত গঙ্গায় দিলি না?

ব্রজ। ভুলে গিছিলেম।

ব্রহ্ম। তুই আমায় গঙ্গায় দিস নে। তুই বাগদী হয়েছিস।

ব্রজ। ঠান্ই‍দিদি! চুপ! ও কথা না।

ব্রহ্ম। তা দিস, পারিস ত গঙ্গায় দিস। আমি আর কথা কব না। কিন্তু ভাই, কেউ যেন আমার চরকা-টরকা ভাঙ্গে না।

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
কয়েক মাস থাকিয়া সাগর দেখিল, প্রফুল্ল যাহা বলিয়াছিল তাহা করিল। সংসারের সকলকে সুখী করিল। শাশুড়ী প্রফুল্ল হইতে এত সুখী যে, প্রফুল্লের হাতে সমস্ত সংসারের ভার দিয়া, তিনি কেবল সাগরের ছেলে কোলে করিয়া বেড়াইতেন। ক্রমে শ্বশুরও প্রফুল্লের গুণ বুঝিলেন। শেষ প্রফুল্ল যে কাজ না করিত, সে কাজ তাঁর ভাল লাগিত না। শ্বশুর শাশুড়ী প্রফুল্লকে না জিজ্ঞাসা করিয়া কোন কাজ করিত না, তাহার বুদ্ধিবিবেচনার উপর তাহাদের এতটাই শ্রদ্ধা হইল। ব্রহ্মঠাকুরাণীও রান্নাঘরের কর্তৃত্ব প্রফুল্লকে ছাড়িয়া দিলেন। বুড়ী আর বড় রাঁধিতে পারে না, তিন বৌ রাঁধে; কিন্তু যে দিন প্রফুল্ল দুই একখানা না রাঁধিত, সে দিন কাহারও অন্ন-ব্যঞ্জন ভাল লাগিত না। যাহার ভোজনের কাছে প্রফুল্ল না দাঁড়াইত, সে মনে করিত, আধপেটা খাইলাম। শেষ নয়ান বৌও বশীভূত হইল। আর প্রফুল্লের সঙ্গে কোন্দল করিতে আসিত না। বরং প্রফুল্লের ভয়ে আর কাহারও সঙ্গে কোন্দল করিতে সাহস করিত না। প্রফুল্লের পরামর্শ ভিন্ন কোন কাজ করিত না। দেখিল, নয়নতারার ছেলেগুলিকে প্রফুল্ল যেমন যত্ন করে, নয়নতারা তেমন পারে না। নয়নতারা প্রফুল্লের হাতে ছেলেগুলি সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইল। সাগর বাপের বাড়ী অধিক দিন থাকিতে পারিল না–আবার আসিল। প্রফুল্লের কাছে থাকিলে সে যেমন সুখী হইত, এত আর কোথাও হইত না।

এ সকল অন্যের পক্ষে আশ্চর্য বটে, কিন্তু প্রফুল্লের পক্ষে আশ্চর্য নহে। কেন না, প্রফুল্ল নিষ্কাম ধর্ম অভ্যাস করিয়াছিল। প্রফুল্ল সংসারে আসিয়াই যথার্থ সন্ন্যাসিনী হইয়াছিল। তার কোন কামনা ছিল না–কেবল কাজ খুঁজিত। কামনা অর্থে আপনার সুখ খোঁজা–কাজ অর্থে পরের সুখ খোঁজা। প্রফুল্ল নিষ্কাম অথচ কর্মপরায়ণ, তাই প্রফুল্ল যথার্থ সন্ন্যাসিনী। তাই প্রফুল্ল এমন শাণিত অস্ত্র। সে যে অদ্বিতীয় মহামহোপাধ্যায়ের শিষ্যা–নিজে পরম পণ্ডিত–সে কথা দূরে থাক, কেহ জানিল না যে, তাহার অক্ষর-পরিচয়ও আছে। গৃহকর্মে বিদ্যা প্রকাশের প্রয়োজন নাই। গৃহকর্ম বিদ্বানেই সুসসম্পন্ন করিতে পারে বটে, কিন্তু বিদ্যা প্রকাশের স্থান সে নয়। যেখানে বিদ্যা প্রকাশের স্থান নহে, সেখানে যাহার বিদ্যা প্রকাশ পায়, সেই মূর্খ। যাহার বিদ্যা প্রকাশ পায় না, সেই যথার্থ পণ্ডিত।

প্রফুল্লের যাহা কিছু বিবাদ, সে ব্রজেশ্বরের সঙ্গে। প্রফুল্ল বলিত, “আমি একা তোমার স্ত্রী নহি। তুমি যেমন আমার, তেমনি সাগরের, তেমনি নয়ান বৌয়ের। আমি একা তোমায় ভোগ-দখল করিব না। স্ত্রীলোকের পতি দেবতা; তোমাকে ওরা পূজা করিতে পায় না কেন?” ব্রজেশ্বর তা শুনিত না। ব্রজেশ্বরের হৃদয় কেবল প্রফুল্লময়। প্রফুল্ল বলিত, “আমায় যেমন ভালবাস, উহাদিগকেও তেমনি ভাল না বাসিলে, আমার উপর তোমার ভালবাসা সম্পূর্ণ হইল না। ওরাও আমি।” ব্রজেশ্বর তা বুঝিত না।

প্রফুল্লের বিষয়বুদ্ধি, বুদ্ধির প্রাখর্য ও সদ্বিবেচনার গুণে, সংসারের বিষয়কর্মও তাহার হাতে আসিল। তালুক মুলুকের কাজ বাহিরে হইত বটে, কিন্তু একটু কিছু বিবেচনার কথা উঠিলে কর্তা আসিয়া গিন্নীকে বলিতেন, “নূতন বৌমাকে জিজ্ঞাসা কর দেখি, তিনি কি বলেন?” প্রফুল্লের পরামর্শে সব কাজ হইতে লাগিল বলিয়া, দিন দিন লক্ষ্মী-শ্রী বাড়িতে লাগিল। শেষ যথাকালে ধন জন ও সর্বসুখে পরিবৃত হইয়া হরবল্লভ পরলোকে গমন করিলেন।

বিষয় ব্রজেশ্বরের হইল। প্রফুল্লের গুণে ব্রজেশ্বরের নূতন তালুক মুলুক হইয়া হাতে অনেক নগদ টাকা জমিল। তখন প্রফুল্ল বলিল, “আমার সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা কর্জ শোধ কর।”
ব্র। কেন, তুমি টাকা লইয়া কি করিবে?

প্র। আমি কিছু করিব না। কিন্তু টাকা আমার নয়–শ্রীকৃষ্ণের;-কাঙ্গাল গরিবের। কাঙ্গাল গরিবকে দিতে হইবে।

ব্র। কি প্রকারে?

প্র। পঞ্চাশ হাজার টাকায় এক অতিথিশালা কর।

ব্রজেশ্বর তাই করিল। অতিথিশালা মধ্যে এক অন্নপূর্ণা-মূর্তি স্থাপন করিয়া অতিথিশালার নাম দিল, “দেবীনিবাস।”

যথাকালে পুত্র-পৌত্রে সমাবৃত হইয়া প্রফুল্ল স্বর্গারোহণ করিল। দেশের লোক সকলেই বলিল, “আমরা মাতৃহীন হইলাম।”

রঙ্গরাজ, দিবা ও নিশি দেবীগড়ে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের প্রসাদভোজনে জীবন নির্ব্বাহ করিয়া পরলোক গমন করিলেন। ভবানী ঠাকুরের অদৃষ্টে সেরূপ ঘটিল না।

ইংরেজ রাজ্য শাসনের ভার গ্রহণ করিল। রাজ্য সুশাসিত হইল। সুতরাং ভবানী ঠাকুরের কাজ ফুরাইল। দুষ্টের দমন রাজাই করিতে লাগিল। ভবানী ঠাকুর ডাকাইতি বন্ধ করিল।

তখন ভবানী ঠাকুর মনে করিল, “আমার প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন।” এই ভাবিয়া ভবানী ঠাকুর ইংরেজকে ধরা দিলেন, সকল ডাকাইতি একরার করিলেন, দণ্ডের প্রার্থনা করিলেন। ইংরেজ হুকুম দিল, “যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে বাস।” ভবানী পাঠক প্রফুল্লচিত্তে দ্বীপান্তরে গেল।

* * * *

এখন এসো প্রফুল্ল! একবার লোকালয়ে দাঁড়াও–আমরা তোমায় দেখি। একবার এই সমাজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বল দেখি, “আমি নূতন নহি, আমি পুরাতন। আমি সেই বাক্য মাত্র; কতবার আসিয়াছি, তোমরা আমায় ভুলিয়া গিয়াছ, তাই আবার আসিলাম–
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।”

——————-
[সমাপ্ত]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন